০৬ ডিসেম্বর ২০১৩

১ম বছর ২য় সংখ্যা

সম্পাদকীয় 

‘প্রতিচ্ছবি’ মূলত একটি সাহিত্য পত্রিকা । ৯০ দশক থেকে অনিয়মিতভাবে প্রকাশিত হয়ে আসছে । আজও তার মূল স্রোত বর্তমান থেকে ক্রমশই ভবিষ্যৎ-এর দিকে ধাবিত হচ্ছে ।
‘প্রতিচ্ছবি’ ছাপা অক্ষরের সাথে পাঠক-পাঠিকারা পরিচিত । সম্প্রতি প্রকাশিত হচ্ছে ওয়েব ম্যাগাজিন রূপে । ঘরে বসে কম্পিউটারে বা হাতের মোবাইলে নেটে সার্চ করলেই পাওয়া যাবে চেনা জানা ‘প্রতিচ্ছবি’ ।
‘প্রতিচ্ছবি’-র এই সংখ্যার দায়িত্ব আমার উপর ছিল । অল্পদিনের সময়ে অনেক কাজ করতে হয়েছে । তাই ভুল ভ্রান্তি থাকতেই পারে । আশা করি প্রিয় এবং কাছের মানুষেরা ভুল বুঝবেন না । সবাই ভালো থাকুন । সবার শুভ হউক জীবনের আয়োজন ।
ধন্যবাদান্তে ---
‘প্রতিচ্ছবি’-র পক্ষে এই সংখ্যার সম্পাদক  

দেবব্রত সরকার 










যোগাযোগ : pratichchhabi@gmail.com


প্রচ্ছদ : অনিরুদ্ধ মুখার্জী 




গৌরশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়

সামান্য সময় 


যাকে চাই
তাকে দেখতে না পেলে
মনে হয়
                     নিঃসঙ্গ বিকেলের
কয়েকটি সত্য জানা হল না
কীভাবে কথার ফাঁকে
একটু জায়গা খুঁজে নেওয়া
সামান্য সময়ের ধুলো লেগে থাকা
                     বসার আসনে থাকে ঘনিষ্ঠ উত্তাপ     

এমন কল্পনা নিয়ে
যদি একদিন কেউ তোমার কাছাকাছি আসে
যার চোখে মুখে নীরোগ সৌন্দর্য
চাল ধোয়া জলের মতো স্বচ্ছতা ছড়িয়ে
                     সেও জানে তুলনীয় হতে

যাকে চাই
তাকে দেখতে পেলে
আরও কয়েকটি পঙক্তি এসে

আমাকেই নিঃসঙ্গ করে দিত 



০৫ ডিসেম্বর ২০১৩

সমীরণ ঘোষ


জলে লেখা লিপি 


এক.
ওড়াতে সচেষ্ট হই পাতার বিমান । নীচে এত তারাঝরা
বোঝেনি মাধুরী তার দর্পণের মোহে ।  বেলা মুছে
ক্রমশ রাত্রিভেলা অববাহিকার দেশেমাধুরী শীতের শ্বাস
ধোঁয়াচ্ছন্ন, কিছুটা জটিল । স্মৃতির রেশম থেকে প্রান্তরের
তীব্র কুয়াশায় । তখন আশ্চর্য ভোর । ফিরে যাচ্ছে
প্রেত পরি কুহেলী সকল
মাধুরী শীতের লিপি, হাওয়ায় পাতায় আর
গানের নিজস্ব কিছু গুপ্ত কোটরে

দুই.
বুঝিনি যদিও । ঢেউ ফিরে ফিরে সীমানার আঁধারশিখর
মাঠের পশ্চিমে ওই ধুলোমেঘ গোধূলিপ্রান্তর । বোবামানুষের
ভাষা, বাতাসে লিখেছি । বাতাসের স্নানে এসে অবাক নিশীথ
মাধুরী উধাও । শুধু তার ভেলা, নিহত সন্ধ্যার হাতে দড়িদড়া
এত রক্ত ও আকন্দ ফুল ঘরের দুয়োরে । শ্বাসের ঘর্ষণে জাগা
স্মৃতিমোম । মাধুরী ফেরেনি । শুধু তার ঘোড়া, দানাপানি
ভিক্ষে নয়, আনতমস্তক, আর নেমে আসা হাওয়ার উচ্ছ্বাস
শুধু ঢেউ আর রাত্রি এসে, চিত্তাকার মেঘ, বলেছে মাধুরি কথা
আর যত অলীক পরিণাম ।

তিন.
নষ্ট কিন্তু প্রকৃতির নিজের সাজানো এই জল, তার ওপর
ঝরে পড়া রমণীর ললাটরঞ্জনী । সহসা দেখেছি কিছু গ্রন্থ
আর পর্যটনমুখী ভ্রমে । উত্তরে দিয়েছি শিস । চকিতে
উড়ন্ত পাখি । পাতার প্রলয় । অন্ধকার যেভাবে পারে
বুজে যায় যেখানে যেটুকু ফাঁক

যে তারাভূমি মাধুরী ফেরত শুয়ে আছে জলে, পাশে
সাপ ভেসে যায় । গাছে গাছে যা কিছু সোনালি, রহস্যের
রক্তিম পোঁচ ওনুবাদ করি, ক্রমে অনূদিত হই
মাধুরী প্রেরিত মেঘ হাওয়া তোলে । আমার ভেতর শুধু
ছাই ওড়া দেখে যায় আমার মুকুর

চার.
নিহত ছিলাম । কিন্তু হাওয়া যেই প্রবেশ করেছে
ঘটনার মেঘ দুইপ্রান্ত থেকে আমাকে ওড়ালো
পাখিও কী উড়ে থাকে মুখে এত কালো লতাপাতা । যেন
মাছি, রহস্যের সেতু ও জানালা সমেত অগাধ সমুদ্রে
আমিও বুঝিনি, আর পলি ও কাঁকর ফেলে গেছি 
মাধুরীর ভেতর-বাগানে । 
মাধুরী জাগেনি, শুধু চাঁদ-ঘোষা তারা, আর সেই ঘোড়া 
দাঁড়ালো ফটকে । মুখে অন্ধকার-লাগা মাধুরীর চিঠি
সমস্ত লিপিই জলে লেখা, নীচে জলের স্বাক্ষর
বলেছিলো যাও, কিন্তু তস্করের মতো ফিরো কোনওদিন
তার পিঠের চাদরে উঠে পুনরায় শুয়ে পড়ি নৃত্যময় পায়ের ছায়ায় 



নাসের হোসেন


পাতা 



কখন যে ঝরে পড়েছে পাতা
এখন কুড়িয়ে নিচ্ছি, পাতার উপরে
কত কিছু লেখা রয়েছে, কিন্তু সব লেখা কি 
সবসময় পড়া যায়, পড়া কি সম্ভব
তবু পড়ে যাচ্ছি, হয়তো শেষ পর্যন্ত
কোনোকিছুই বোঝা যাবে না
শুধু এই পড়ার আনন্দ 




গোবিন্দ ত্রিবেদী


মধ্যবিত্ত : সপ্তদশীকলা 



যেখানে নীল পাখি উড়ে, বাসা বাঁধে অসংখ্য নক্ষত্র
তার ভিড়ে হারিয়ে যায় স্বপ্নের লাবণ্য স্মৃতি
কনক স্রোতে ভাসে জীবন-দহন । কাকে বলো সুগন্ধ
প্রত্যুষ । এখন সেই নীল পাখি ক্লান্তির জালে । আমার মরমী

যার হাতে ছিল মকর অক্ষর সে হাতে বাঁধা দিনপাত
ননীর নরম ছোঁয়া আদুরে রাতে মলয়ে মিশাক
যত ভার বহন করে মেঘ তুমুল বৃষ্টি ভাঙে বাঁধ
সে কামিনী ফুল, পলক সম্পাতে আমারি পীড়ন-নির্যাস

ভুলে থাকি মধ্যবিত্ত দীর্ণা সপ্তদশীর ছায়া কল্পকলা 
স্ব-ভাবে মিশে যায় শব্দ মিছিল, থাকে শুধু দূর পথ চলা । 




সন্দীপ বিশ্বাস


সমীক্ষা 



দিনগুলো সব ফুরিয়ে যাচ্ছে
আর আমি কথার ভিতরে কথা
সাজিয়ে রাখছি ।

কোনো গাছের বৃত্ত কথা
একজন মানুষ তার ভিটেমাটি
চোখের মধ্যে চোখ – কর্মকাণ্ড
বেঁধে রাখছি ।

কী উঠলো--- কী নামলো
কে ভাঙলো--- কে ছাড়লো 
কে জুটলো--- আদিগন্ত ফেরার ।

কলমে যখন আঁট ধরেছে
ক্লান্ত আমার মুখের বালাই
এই যে আমার জন্মভূমি 




নিখিলকুমার সরকার


মুঠোফোনের ভাষায় 


১.
দুঃখ সুখের পথ চেয়ে
রয়েছে অপেক্ষায়
সুখ ওর খবর রাখে না
নিজের ইচ্ছে-ঘাট ছুঁয়ে ছুঁয়ে
নৌকা বায়

২.
বিন্যস্ত পঙক্তির ভেতর যদি না থাকি
স্পেসের শূন্যতায় আমাকে খুঁজে দেখো ...

৩.
সবসময় রংবেরং সম্পর্কবলয়
তোমাকে ঘিরে থাকে ... এটা ঠিক
পৃথিবীতে তুমি একক প্রজাতি 
নিতান্ত একা ... এও কি সত্যি নয় ?

৪.
পথ পৌঁছে দিতে চায়
যদিও, প্রকৃত পথিকের কোনও গন্তব্য থাকে না
পথ কি তা জানে 



তিমির মিত্র


খোঁজ 



খোঁজার নেশা বহুদিনের ।
শৈশবেই মনে হয়েছে আমি যেন
কিছু খুঁজছি । খুঁজতে খুঁজতে কখন
কৈশোর এলো – তারপর একদিন
যৌবনও দুয়োরে কড়া নাড়লো ।
এমন সময় হঠা ৎ দেখলাম আমার
খোঁজার পথে ‘যেন’টা চলে গেছে
সেটা ছিল আমার খোঁজার প্রথম পুরস্কার ।
তারপর যৌবন গড়িয়ে গড়িয়ে প্রৌঢ়ত্বের
দ্বার প্রান্তে আসতেই আমার
বিচ্ছিন্ন খোঁজাটা এক লক্ষ্য হ’লো ।
সেটা আমার দ্বিতীয় পুরস্কার ।
একলব্যর মতো একলক্ষ্যে চলতে চলতে
এক আজব শহরে এলাম ।
এখানে রাতেও সূর্য জ্বলে থাকে ।
চোখ-ধাঁধানো আলোতে চোখের
কষ্ট হতে হতে একদিন দেখি
আলো আর আমার চোখের পীড়ন
নয় । তাঁকে ছুঁতে চাই পারি না
আস্বাদন করতে চাই তাও পারি না ।
এক অসহায় তীব্র আনন্দ --
যাকে বন্টনের সামগ্রীও করতে পারি না । 



তুষার ভট্টাচার্য


ম্যাজিক লণ্ঠন 



এই গার্হস্থ্য জীবনের অলীক দুঃখের সরণি পেরিয়ে 
আমি মাটির গভীরে যেতে চাই,
বীজের অঙ্কুরে, দীঘল গাছের শিকড়ে আজও
খুঁজে যাই উত্তরাধিকারের চন্দন ঘ্রাণ;
কাদামাটি ছেনে ছেনে একদিন ঠিক  
পেয়ে যাব ঠাই ওই
পাকা হলুদ ধানরঙের –--
মতন আদুল প্রান্তরের মাঠে;
সেখানে জোছনা রাত্তিরে মাটির সুবাস নিয়ে হৃদয়ে
জ্বলে উঠবে ভালবাসার ম্যাজিক লণ্ঠন । 




কবিরুল ইসলাম কঙ্ক


আমি কবি, ইভ জানে 


ইভের হাতে গোলাপ তুলে দিয়ে
আমিই প্রথম বলেছিলাম---‘চলো, গভীর অরণ্যে যাই’
পাপড়ির নরম স্তরে না বলা কথা, অবিন্যস্ত পঙক্তি দিয়ে
ইভ তার নগ্ন শরীর ঢেকেছিল
চুইয়ে পড়া সূর্যরশ্মি স্পর্শ, স্নায়ুকোষে জৈবিক ক্রিয়া
আদিম অরণ্যের নির্ভেজাল উন্মুক্ত ঠোঁটে ইভ
আমাকে পুরোপুরি প্রস্তুরীভূত করে সৃষ্টি রহস্য শিখিয়েছিল

সেই থেকে আজ অব্দি ভেসে গেছি উজানি সভ্যতায়
নির্দিষ্ট কক্ষপথে হাঁটছি অ্যামিবার মতো, নদীর মতো, ঝরনার মতো
অজান্তে হয়ে গেছি প্রতিটি পাতায় ইতিহাসের ফসিল  
চেতনার পাথর স্তরে অস্তিত্বের প্রত্নতাত্ত্বিক খোঁজ  
আমি সৃষ্টি রহস্যে এখনও সেই পরিবর্তনহীন জীবাণু
পাশাপাশি ইভ গর্ভে ধারণ করে প্রজন্মের পর প্রজন্ম

শর্ত সাপেক্ষে, আমি পৃথিবীর আদিম পুরুষ বটে
তবে ইভের পেলব ছোঁয়ায় অদম্য উত্তেজনাকাল
আমার মধ্যে জন্ম দিয়েছে অসংখ্য কবিতা
যা আমি ইভের জরায়ুতে নিয়মিত সরবরাহ করেছি

আমি যে আসলে কবি, তা ইতিহাস জানে না  
ইভ জানে   



তানিয়া চক্রবর্তী

কিছু পরে

আসলে বলছিলাম কিছু পরে,
কিছু পরে ফিরে আসব
সময় একটা অলীক অতীত হতে পারে
                    ---তোমার কাছে
আমার কাছে বিশ্রামরত শিল  মাছের বোকা হেলান
তুমি নির্বাক অথচ ঘনিষ্ঠ বলে যন্ত্রণায় আঠা লাগাই
মিথ্যে কিছু সময় বন্ধ রাখি
তুমি অপেক্ষারত--- ভাবলেই ভুল করি
এই সময়টা বাহানার বাসনায় ফেরত দেব তোমায়
আসলে তোমারও কিছু পরে যাব  আমি
চলে যাওয়াটা একটা অশরীরী রীতি
যদি জানো ব্যাথা কোথায়, তাহলে তুমি  ব্যাথিত নও 
যদি জানো ব্যাথা কোথাও নেই, অথচ তুমি ব্যাথিত
তাহলে জেনো, পর্ণমোচীর শেষ  পাতার মতো
জর্জরিত হয়ে গেছে তোমার  গন্ধ
এটা প্রয়োজন, আরো কিছু পরে  তুমি বুঝবে

আমারও যাওয়াটা তোমার নিতান্ত  প্রয়োজন 



সানি সরকার


সুর, সম্পর্ক, মগ্নতা 




পিয়ানোর সামনে যখন দাঁড়াই
প্রতিটি সম্পর্কের সুরগুলো সামনে
এসে দাঁড়ায়, ওষ্ঠ ভিজে যায় ...
একটি সুতো সামনে দোলে, আর বড় আপন মনে হয়
অভিজাত রঙের মধ্যিখানে আমি
তাদের বেড়ে যেতে দিই
ইচ্ছে মতো
পিয়ানোর সামনে স্পষ্ট দেখা যায়
একটি মৌরি গাছ, একটি নিঝুম
গোলক

এমন চমৎকার দৃশ্যের ভেতর এক মুহূর্তেই

নড়ে উঠল নাভি মূলের আগুন, ধ্বংসস্তূপ ... 








রাজকুমার শেখ


এই বৃষ্টির কসম, চোখের জলে চাঁদ ধুয়েছি 




এই বৃষ্টির ফোঁটা ছুঁয়ে বলছি
তুমি আমার শ্রাবণ খোলা আকাশ
আমার মুঠোয় ভরা ছাতিম গন্ধ
আমার সুখ
আমার দুঃখ
আমার বাশির সুর ।
এই বৃষ্টির মতো পেয়েছি তোমাকে


চোখের বৃষ্টি ফোটাতে ধুয়ে রাখি আমার চাঁদ ...