সংগ্রাহক - সুমন হাসান
সাহিত্যিক নারায়ণ স্যান্যাল মহাশয়ের একটি স্মৃতিকথনের পাতা থেকে
“ এবার একেবারে হাল-আমলের কথা বলি। পঁচাত্তর সালে ফেব্রুয়ারি মাসের কথা। বড় মেয়ের বিয়েতে আচার্য সুনীতিকুমার এসেছিলেন আমার বাড়ীতে পদধূলি দিতে। সেই গল্পই বলব এখন।
বর আসার কথা গোধূলি-লগ্নে, মানে সন্ধ্যা ছয়টা নাগাদ। প্রথম ব্যাচ নিমন্ত্রিত খেতে বসবে আন্দাজ সাতটায়। সেই মর্মেই আমরা তৈরী হচ্ছি। আমি সম্প্রদান করব, উপোস করে আছি। এমনিতেই আমার লো-ব্লাডপ্রেশার। বয়স, আগেই বলেছি, পঞ্চাশোর্ধে। হঠাৎ কে যেন এসে বলল, নিচে একটা গাড়ি এসেছে। তাতে আচার্য সুনীতিকুমার এসেছেন। বেলা পাঁচটা তখন।
আমি থাকি তিনতলায়। তাড়াতাড়ি চটিটা পরে নিচে যাবার উপক্রম করি। আবার কে এসে খবর দিল নামতে হবে না – উনি নিজেই উপরে উঠে আসছেন। তাই এলেন উনি। হাতে মোটা লাঠি, চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। কোন ল্যান্ডিং-এ না থেমে গট্গট্ করে একেবারে উঠে এলেন ত্রিতলে। আমাকে দেখতে পেয়েই বললেন, সন্ধ্যা সাতটায় একটা ‘বক্তিমে’ আছে ; অথচ একবার ‘ঢু’ মেরে না গেলেও চলে না। কই, মেয়ে কোথায় ?
ওঁর হাতে খানদুই বই, ফিতে দিয়ে বাঁধা। ওঁরই লেখা গ্রন্থ। আশীর্বাদ করবেন বই দিয়ে। আমি ওঁকে বসিয়ে ভেতরে খবর দিতে গেলাম। কিন্তু অন্দরমহলে এসে বুঝতে পারি কাজটা অত সহজ নয়। বুলবুলের বান্ধবীর দল – স্বাতী, শান্তা, রাখীরা বসেছে কনে সাজাতে। কনের ছোট ভাই রাণা নাকি তুলির কাজে সুনাম অর্জন করেছে – যাকে বলে ‘বর্ণিকাভঙ্গ’ আর কি। তুলি চন্দন নিয়ে সে অপেক্ষা করছে। খোঁপা বাঁধা শেষ হলে তার কাজ শুরু হবে। আমি ভয়ে ভয়ে বললুম, বুলবুল একবার বাইরের ঘরে আসতে হবে। প্রণাম করতে।
হাঁ হাঁ করে উঠল সবাই। এ কী অনাসৃষ্টি কথা ! আধ-সাজা কনে কখনও ঘর ছেড়ে বের হয় নাকি ? আমি আমতা আমতা করি, মানে আচার্য সুনীতিকুমার এসেছেন। বেশীক্ষণ বসবেন না ; তাহলে ওঁকেই এঘরে নিয়ে আসি ?
তাতেও আপত্তি ওদের ! সাজ শেষ না হলে সে কেমন করে বাইরের লোকের সামনে দাঁড়াবে ? বুলবুলের বান্ধবী বললে, তা হয় না। বৌদি নলল্রন, বাহাত্তর তো তোমার হইয়নি ঠাকুরপো, এর মধ্যেই ভীমরথী ধরেছে !
অগত্যা আবার ফিরে এলাম বাইরের ঘরে।
ভাগ্য ভাল। এসে দেখি আমার দাদা, ভায়রাভাই ইত্যাদি সবাই সুনীতিকুমারকে ঘিরে জমিয়ে বসেছেন। উনিও দিব্যি জাঁকিয়ে গল্প ফেঁদেছেন। দাদা ওঁকে বললেন, রান্না এখনো সব হয়নি, যা হয়েছে সামান্য কিছু নিয়ে আসি ?
-- আনুন ! অল্প অল্প করে চেখে দেখি !
দাদা আমাকে চোখের ইঙ্গিত করলেন।
ভোজের রান্নার হাঙ্গামা আমি নিজের স্কন্ধে রাখিনি। সাতাশ বছর ‘ব্যান্ডো সাহেবে’র কাছে ট্রেনিং পেয়েছি – বাজার করতে জানি না। তাই ও দায়িত্বটা দিয়েছিলাম একটি ক্যাটারিং এজেন্সিকে। দক্ষিণ কলকাতার সবচেয়ে নাম করা ক্যাটারার – বিজলী গ্রিলকে। তাঁরাই রান্নাবান্নার ব্যবস্থা করেছেন ছাদে। সেখানেই প্যান্ডেল। লোকজন খাবেও সেখানে। সিঁড়ি বেয়ে ছাদে উঠে গেলাম। বিজলী গ্রিল-এর ম্যানেজার ভদ্রলোক অতি অমায়িক। দুপুর থেকেই রান্নার তদারকী করছেন। তাঁকে বলা ছিল প্রথম ব্যাচ খেতে বসবে সন্ধ্যা সাততায়। আমাকে উঠে আসতে দেখে ভদ্রলোক নিজেই এগিয়ে এলেন, বলুন স্যার ?
- দেখুন, আমার একজ্জন অতি বিশিষ্ট নিমন্ত্রিত ভদ্রলোক এসে পড়েছেন। আপনার কী কী রান্না হয়েছে বলুন তো ? একটা প্লেটে সাজিয়ে দিন আমি নিয়ে যাই।
উনি বললেন, পাঁপড় ভাজা ছাড়া সবই তৈরী হয়েছে। আপনি নিচে যান। আমি প্লেট সাজিয়ে নিয়ে যাচ্ছি।
আমি বলি, না না, ঐসব ছ্যাঁচড়া-ট্যাঁচড়া ওসব কিছু নেবার দরকার নেই। মেন আইটেম কয়েকটি ---
-- তবে স্যার খানকয় রাধাবল্লভী, মাংস আর ফিশ্ ওলী নিয়ে যাই ?
-- ফিশ্-এর কী ?
-- আজ্ঞে ‘ফিশ্ ওলী’ !
সেটা কি বস্তু জানা ছিল না। মেনুটা ঠিক হয়েছে আমার অজান্তে। ‘ফিশ ওলী’ নিশচয় কোন আধুনিক সুখাদ্য হবে। অজ্ঞতা প্রকাশ হয়ে যাবার ভয়ে আমি হেসে বলি, ও ফিশ, ওলী। তাই বলুন !
একটু পরে একটি থালায় আহার্য সাজিয়ে ভদ্রলোক নিচে নেমে এলেন। মেজদি নিরামিষ হেঁশেল থেকে পৃথক পাত্রে দই-মিষ্টি নিয়ে এলেন। সুনীতিকুমার বললেন, এত কে খাবে ?
তারপর যেমন হয়ে থাকে। এ পক্ষের পীড়াপীড়ি আর ও পক্ষের ব্যাঘ্র ঝম্পন !
বিজলী গ্রিল-এর স্যুট-পরা ম্যানেজার ভদ্রলোক ঠায় দাঁড়িয়ে থাকলেন। কখন কি লাগবে, জলের গ্লাসটা খালি হল কিনা ! ঐ মওকায় আমি একবার অন্দরমহলটা পাক মেরে এলাম। কনের ‘কনে-চন্দন’ পরানো শুরু হয়েছে। আহারপর্ব মিটতে মিটতেই সজ্জাপর্ব সারা হয়ে যাবে আশা হচ্ছে। এদিকে বরের গাড়িও যে কোন মুহূর্তে এসে পড়তে পারে ; আবার ওদিকে যে কোন মুহূর্তে ঝেঁপে বৃষ্টিও নামতে পারে। আকাশ আছে মুখ কালো করে সেই ফেব্রুয়ারির পনেরো তারিখে।
হঠাৎ সুনীতিকুমার একটি ভোজ্যদ্রব্যের দিকে তর্জনী নির্দেশ করে বললেন, ওটা কি ?
দাদা, মেজদা দুজনেই মুখে চাওয়া-চাওয়ি করেন। আমি সদ্যলব্ধ জ্ঞানটা বিতরণের এমন সুযোগ হেলায় হারাতে রাজি নই। বললুম, ওটা ইয়ে স্যার, ফিশ্ ওলী !
-- ফিশ্-এর কী ?
-- আজ্ঞে ফিশ্ ওলী ! ... মানে ও’লী ! ফিশ্-এর ওলী আর কি !
সুনীতিকুমারের চর্বনকার্য বন্ধ হল। সোজা হয়ে বসলেন তিনি। বললেন, ‘ফিশ্-এর ওলী’ মানে কী ? কোন দেশী খাবার ?
আমার বিদ্যে ফুরিয়েছে। বিজলী গ্রিলের ম্যানেজারের দিকে করুণনেত্রে আমাকে তাকাতে হল। সে ভদ্রলোক বললেন, ভেটকি মাছের ফিশ্ ওলী স্যার ! ইয়ে... মানে, ফিশ্ ও’লি !
-- বানান কী ?
ম্যানেজার ভদ্রলোক গলার টাইটা একটু আলগা করে দিয়ে বললেন, ‘ও’ আর ‘লয়ে দীর্ঘঈ’।
সুনীতিকুমার গম্ভীর হয়ে বললেন, সেটা তো সাঁত্রাগাছীর ওল ‘স্ত্রীয়াম্ ঈপ্’। আমি রোমান হরফে বানানটা জানতে চাইছি।
ম্যানেজার এবার নিজেই অফফতা স্বীকার করে বললেন, ঠিক জানি না। বোধহয়, OLEE. । শুনেছি জার্মান,......নয় ; ফ্রেঞ্চ্ ডিশ্।
সুনীতিকুমার হাত গুটিয়েছেন। বলেন, উহুঁ। জার্মান ভাষায় ভাজাকে বলে gebacken অথবা gebraten ; ফরাসি ভাষায় ভাজা মাছ হচ্ছে frit poisons । ‘ওলী’ তো জার্মান-ফরাসী খাদ্য তালিকায় নেই। ‘ওলী’ শব্দটা কোথা থেকে এল ?
মাথায় উঠল খাওয়া। উনি আরও ভেবে বললেন, স্প্যানিশ ভাষায় যতদূর মনে পড়ছে মাছ ভাজা হচ্ছে frito pescado – ইতালিয়ান ভাষায় Fritte pesce । OLEE কোথা থেকে এল ?
আমার মেজদা নিরুপায় হয়ে বললেন, আজ্ঞে আপাতত এল রান্নাঘর থেকে। স্রেফ ‘মাছ ভাজা’ বলেই ধরেই নিন না। ব্যুৎপত্তিগত না হক, উৎপত্তিগত হদিসটা তো পেলেন।
সুনীতিকুমার ওঁর সরল রসিকতায় খুশি হলেন। জবাবে বললেন, তাই বলুন ! মাছ ভাজা ! ওলী নয় ! তাহলে ও-পিঠটা খাওয়া যেতে পারে। ওলীর এ-পিঠ ও-পীঠ কিছুই চিনি না, কিন্তু ভাজা মাছ উল্টে খেতে জানি !
একটু পরেই বুলবুলি এসে প্রণাম করল ওঁকে। আশীর্বাদ করলেন উনি। মনে মনে। জোরে জোরে বললেও বুঝতুম না অবশ্য। হিব্রু-গ্রিক-লাতিন কী ভাষায় বলতেন কে জানে ?
উনি রওনা হবার পর ‘বিজলী ফ্রিল’-এর ম্যানেজার ভদ্রলোক এসে আমাকে প্রশ্ন করেন, উনি কে স্যার ?
বললুম, আমাদের জাতীয় অধ্যাপক আচার্য সুনীতিকুমার। ভাষাবিদ ! ম্যানেজার বললেন, আর ক’জন এমন ভাষাবিদ আপনার নিমন্ত্রিত আছেন স্যার ?
বললুম, না, আর কেউ নেই। আপনি এরপর নির্ভয়ে ‘ফিশ্ ওলী’ চালাতে পারেন।
ভদ্রলোক রসিক। বললেন, আজ্ঞে না, আর ভয়ের কি আছে ! এখন তো আমার জানাই হয়ে গেছে – উৎপত্তিগত হদিস ; রান্নাঘর ! আর ব্যুৎপত্তিগত ; সাঁত্রাগাছীর ওল ‘স্ত্রীয়াম্ ঈপ্ ! ’
সাহিত্যিক নারায়ণ স্যান্যাল মহাশয়ের একটি স্মৃতিকথনের পাতা থেকে
“ এবার একেবারে হাল-আমলের কথা বলি। পঁচাত্তর সালে ফেব্রুয়ারি মাসের কথা। বড় মেয়ের বিয়েতে আচার্য সুনীতিকুমার এসেছিলেন আমার বাড়ীতে পদধূলি দিতে। সেই গল্পই বলব এখন।
বর আসার কথা গোধূলি-লগ্নে, মানে সন্ধ্যা ছয়টা নাগাদ। প্রথম ব্যাচ নিমন্ত্রিত খেতে বসবে আন্দাজ সাতটায়। সেই মর্মেই আমরা তৈরী হচ্ছি। আমি সম্প্রদান করব, উপোস করে আছি। এমনিতেই আমার লো-ব্লাডপ্রেশার। বয়স, আগেই বলেছি, পঞ্চাশোর্ধে। হঠাৎ কে যেন এসে বলল, নিচে একটা গাড়ি এসেছে। তাতে আচার্য সুনীতিকুমার এসেছেন। বেলা পাঁচটা তখন।
আমি থাকি তিনতলায়। তাড়াতাড়ি চটিটা পরে নিচে যাবার উপক্রম করি। আবার কে এসে খবর দিল নামতে হবে না – উনি নিজেই উপরে উঠে আসছেন। তাই এলেন উনি। হাতে মোটা লাঠি, চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। কোন ল্যান্ডিং-এ না থেমে গট্গট্ করে একেবারে উঠে এলেন ত্রিতলে। আমাকে দেখতে পেয়েই বললেন, সন্ধ্যা সাতটায় একটা ‘বক্তিমে’ আছে ; অথচ একবার ‘ঢু’ মেরে না গেলেও চলে না। কই, মেয়ে কোথায় ?
ওঁর হাতে খানদুই বই, ফিতে দিয়ে বাঁধা। ওঁরই লেখা গ্রন্থ। আশীর্বাদ করবেন বই দিয়ে। আমি ওঁকে বসিয়ে ভেতরে খবর দিতে গেলাম। কিন্তু অন্দরমহলে এসে বুঝতে পারি কাজটা অত সহজ নয়। বুলবুলের বান্ধবীর দল – স্বাতী, শান্তা, রাখীরা বসেছে কনে সাজাতে। কনের ছোট ভাই রাণা নাকি তুলির কাজে সুনাম অর্জন করেছে – যাকে বলে ‘বর্ণিকাভঙ্গ’ আর কি। তুলি চন্দন নিয়ে সে অপেক্ষা করছে। খোঁপা বাঁধা শেষ হলে তার কাজ শুরু হবে। আমি ভয়ে ভয়ে বললুম, বুলবুল একবার বাইরের ঘরে আসতে হবে। প্রণাম করতে।
হাঁ হাঁ করে উঠল সবাই। এ কী অনাসৃষ্টি কথা ! আধ-সাজা কনে কখনও ঘর ছেড়ে বের হয় নাকি ? আমি আমতা আমতা করি, মানে আচার্য সুনীতিকুমার এসেছেন। বেশীক্ষণ বসবেন না ; তাহলে ওঁকেই এঘরে নিয়ে আসি ?
তাতেও আপত্তি ওদের ! সাজ শেষ না হলে সে কেমন করে বাইরের লোকের সামনে দাঁড়াবে ? বুলবুলের বান্ধবী বললে, তা হয় না। বৌদি নলল্রন, বাহাত্তর তো তোমার হইয়নি ঠাকুরপো, এর মধ্যেই ভীমরথী ধরেছে !
অগত্যা আবার ফিরে এলাম বাইরের ঘরে।
ভাগ্য ভাল। এসে দেখি আমার দাদা, ভায়রাভাই ইত্যাদি সবাই সুনীতিকুমারকে ঘিরে জমিয়ে বসেছেন। উনিও দিব্যি জাঁকিয়ে গল্প ফেঁদেছেন। দাদা ওঁকে বললেন, রান্না এখনো সব হয়নি, যা হয়েছে সামান্য কিছু নিয়ে আসি ?
-- আনুন ! অল্প অল্প করে চেখে দেখি !
দাদা আমাকে চোখের ইঙ্গিত করলেন।
ভোজের রান্নার হাঙ্গামা আমি নিজের স্কন্ধে রাখিনি। সাতাশ বছর ‘ব্যান্ডো সাহেবে’র কাছে ট্রেনিং পেয়েছি – বাজার করতে জানি না। তাই ও দায়িত্বটা দিয়েছিলাম একটি ক্যাটারিং এজেন্সিকে। দক্ষিণ কলকাতার সবচেয়ে নাম করা ক্যাটারার – বিজলী গ্রিলকে। তাঁরাই রান্নাবান্নার ব্যবস্থা করেছেন ছাদে। সেখানেই প্যান্ডেল। লোকজন খাবেও সেখানে। সিঁড়ি বেয়ে ছাদে উঠে গেলাম। বিজলী গ্রিল-এর ম্যানেজার ভদ্রলোক অতি অমায়িক। দুপুর থেকেই রান্নার তদারকী করছেন। তাঁকে বলা ছিল প্রথম ব্যাচ খেতে বসবে সন্ধ্যা সাততায়। আমাকে উঠে আসতে দেখে ভদ্রলোক নিজেই এগিয়ে এলেন, বলুন স্যার ?
- দেখুন, আমার একজ্জন অতি বিশিষ্ট নিমন্ত্রিত ভদ্রলোক এসে পড়েছেন। আপনার কী কী রান্না হয়েছে বলুন তো ? একটা প্লেটে সাজিয়ে দিন আমি নিয়ে যাই।
উনি বললেন, পাঁপড় ভাজা ছাড়া সবই তৈরী হয়েছে। আপনি নিচে যান। আমি প্লেট সাজিয়ে নিয়ে যাচ্ছি।
আমি বলি, না না, ঐসব ছ্যাঁচড়া-ট্যাঁচড়া ওসব কিছু নেবার দরকার নেই। মেন আইটেম কয়েকটি ---
-- তবে স্যার খানকয় রাধাবল্লভী, মাংস আর ফিশ্ ওলী নিয়ে যাই ?
-- ফিশ্-এর কী ?
-- আজ্ঞে ‘ফিশ্ ওলী’ !
সেটা কি বস্তু জানা ছিল না। মেনুটা ঠিক হয়েছে আমার অজান্তে। ‘ফিশ ওলী’ নিশচয় কোন আধুনিক সুখাদ্য হবে। অজ্ঞতা প্রকাশ হয়ে যাবার ভয়ে আমি হেসে বলি, ও ফিশ, ওলী। তাই বলুন !
একটু পরে একটি থালায় আহার্য সাজিয়ে ভদ্রলোক নিচে নেমে এলেন। মেজদি নিরামিষ হেঁশেল থেকে পৃথক পাত্রে দই-মিষ্টি নিয়ে এলেন। সুনীতিকুমার বললেন, এত কে খাবে ?
তারপর যেমন হয়ে থাকে। এ পক্ষের পীড়াপীড়ি আর ও পক্ষের ব্যাঘ্র ঝম্পন !
বিজলী গ্রিল-এর স্যুট-পরা ম্যানেজার ভদ্রলোক ঠায় দাঁড়িয়ে থাকলেন। কখন কি লাগবে, জলের গ্লাসটা খালি হল কিনা ! ঐ মওকায় আমি একবার অন্দরমহলটা পাক মেরে এলাম। কনের ‘কনে-চন্দন’ পরানো শুরু হয়েছে। আহারপর্ব মিটতে মিটতেই সজ্জাপর্ব সারা হয়ে যাবে আশা হচ্ছে। এদিকে বরের গাড়িও যে কোন মুহূর্তে এসে পড়তে পারে ; আবার ওদিকে যে কোন মুহূর্তে ঝেঁপে বৃষ্টিও নামতে পারে। আকাশ আছে মুখ কালো করে সেই ফেব্রুয়ারির পনেরো তারিখে।
হঠাৎ সুনীতিকুমার একটি ভোজ্যদ্রব্যের দিকে তর্জনী নির্দেশ করে বললেন, ওটা কি ?
দাদা, মেজদা দুজনেই মুখে চাওয়া-চাওয়ি করেন। আমি সদ্যলব্ধ জ্ঞানটা বিতরণের এমন সুযোগ হেলায় হারাতে রাজি নই। বললুম, ওটা ইয়ে স্যার, ফিশ্ ওলী !
-- ফিশ্-এর কী ?
-- আজ্ঞে ফিশ্ ওলী ! ... মানে ও’লী ! ফিশ্-এর ওলী আর কি !
সুনীতিকুমারের চর্বনকার্য বন্ধ হল। সোজা হয়ে বসলেন তিনি। বললেন, ‘ফিশ্-এর ওলী’ মানে কী ? কোন দেশী খাবার ?
আমার বিদ্যে ফুরিয়েছে। বিজলী গ্রিলের ম্যানেজারের দিকে করুণনেত্রে আমাকে তাকাতে হল। সে ভদ্রলোক বললেন, ভেটকি মাছের ফিশ্ ওলী স্যার ! ইয়ে... মানে, ফিশ্ ও’লি !
-- বানান কী ?
ম্যানেজার ভদ্রলোক গলার টাইটা একটু আলগা করে দিয়ে বললেন, ‘ও’ আর ‘লয়ে দীর্ঘঈ’।
সুনীতিকুমার গম্ভীর হয়ে বললেন, সেটা তো সাঁত্রাগাছীর ওল ‘স্ত্রীয়াম্ ঈপ্’। আমি রোমান হরফে বানানটা জানতে চাইছি।
ম্যানেজার এবার নিজেই অফফতা স্বীকার করে বললেন, ঠিক জানি না। বোধহয়, OLEE. । শুনেছি জার্মান,......নয় ; ফ্রেঞ্চ্ ডিশ্।
সুনীতিকুমার হাত গুটিয়েছেন। বলেন, উহুঁ। জার্মান ভাষায় ভাজাকে বলে gebacken অথবা gebraten ; ফরাসি ভাষায় ভাজা মাছ হচ্ছে frit poisons । ‘ওলী’ তো জার্মান-ফরাসী খাদ্য তালিকায় নেই। ‘ওলী’ শব্দটা কোথা থেকে এল ?
মাথায় উঠল খাওয়া। উনি আরও ভেবে বললেন, স্প্যানিশ ভাষায় যতদূর মনে পড়ছে মাছ ভাজা হচ্ছে frito pescado – ইতালিয়ান ভাষায় Fritte pesce । OLEE কোথা থেকে এল ?
আমার মেজদা নিরুপায় হয়ে বললেন, আজ্ঞে আপাতত এল রান্নাঘর থেকে। স্রেফ ‘মাছ ভাজা’ বলেই ধরেই নিন না। ব্যুৎপত্তিগত না হক, উৎপত্তিগত হদিসটা তো পেলেন।
সুনীতিকুমার ওঁর সরল রসিকতায় খুশি হলেন। জবাবে বললেন, তাই বলুন ! মাছ ভাজা ! ওলী নয় ! তাহলে ও-পিঠটা খাওয়া যেতে পারে। ওলীর এ-পিঠ ও-পীঠ কিছুই চিনি না, কিন্তু ভাজা মাছ উল্টে খেতে জানি !
একটু পরেই বুলবুলি এসে প্রণাম করল ওঁকে। আশীর্বাদ করলেন উনি। মনে মনে। জোরে জোরে বললেও বুঝতুম না অবশ্য। হিব্রু-গ্রিক-লাতিন কী ভাষায় বলতেন কে জানে ?
উনি রওনা হবার পর ‘বিজলী ফ্রিল’-এর ম্যানেজার ভদ্রলোক এসে আমাকে প্রশ্ন করেন, উনি কে স্যার ?
বললুম, আমাদের জাতীয় অধ্যাপক আচার্য সুনীতিকুমার। ভাষাবিদ ! ম্যানেজার বললেন, আর ক’জন এমন ভাষাবিদ আপনার নিমন্ত্রিত আছেন স্যার ?
বললুম, না, আর কেউ নেই। আপনি এরপর নির্ভয়ে ‘ফিশ্ ওলী’ চালাতে পারেন।
ভদ্রলোক রসিক। বললেন, আজ্ঞে না, আর ভয়ের কি আছে ! এখন তো আমার জানাই হয়ে গেছে – উৎপত্তিগত হদিস ; রান্নাঘর ! আর ব্যুৎপত্তিগত ; সাঁত্রাগাছীর ওল ‘স্ত্রীয়াম্ ঈপ্ ! ’
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন