০২ সেপ্টেম্বর ২০১৭

৪র্থ বছর ৯ম সংখ্যা






গুচ্ছ কবিতা - সমীরণ ঘোষ

কুয়োতলা

অচেনাকালের কোনো কুয়োতলা
লন্ঠনের জীর্ণ আলোয় দুলেছিল

এত দূরদেশ, তবু সে-অলীক ছায়া
তোমাদের স্নানের উঠোনে

শুধুই বিভ্রম বলো!
প্রক্ষালনের জল ঝুঁকে এসে কিভাবে বাড়ালে !



ফসিল

ভূগোল পালটে যায়। শস্যরেখ কিছুতে সরে না
সর্পবাণ, বাঁধে বোধ ভূমি পৃথুল সংসার

মুছে গিয়ে এখনও অনেক প্রথা, ব্রতাচার, মগ্ন পিলসুজ
মাটির প্রদীপ জলে ভেসে যায়। এ-সড়কে বায়ুযান
কিংবা মৃৎশকট, সমূহ রক্তের ছায়া ...

বাঁচো কিংবা অতিকায় সত্বেও ছুটি

ফসিলই বলে থাকে কার কিভাবে যাত্রা
কেমন নিষ্ক্রমণ



ভৈরবী

দেহে যা বলছি তাই মাত্রাবোধ
ধীরে, যা প্রবেশ্য, আর পূর্বাপর

মৃত্যু অধিক কোনো সিন্ধু-সন্ধ্যার রেখা

তুমি, সহজীবনের মূলে
সুপ্ত আদিম ভবকাল



অস্তরাগ

হত্যায় মোছেনি সব
কিছু মৃত্যুর আগুনে জ্বলেছিল

রেললাইনের পাশে মুণ্ড ধড়
তামাদি চিহ্ন কিছু পড়ে

ডাকি। কখন জাগবে!

অন্নের চূড়োয় এসে রোজ রোজ সূর্য ঢলে যায় 



কবিরুল ইসলাম কঙ্ক

তবু, তুমি

প্রত্যহ
এসে দাঁড়াও
ভাবনার আকাশে,
এই দেহ
হৃদয় কাঁপাও
দারুণ প্রকাশে ।

ভাবি, কোনোদিন
যাব না প্রেমে,
নিজেকে রাখবো
মনের ফ্রেমে ।

তবু, তুমি
সন্ধ্যাতারায়
হও মনোরম,
ভাঙনরেখায়
ভালোবাসার
অঙ্কুরোদগম ।



দেবব্রত সরকার

মনচাঁদ

যা মন উড়িয়েই দিলাম আমি ধর
ফাঁদ পেতে নয় মন রেখে মন ধর
পলাশ ডাঙ্গায় কুড়িয়ে নেবো ফাল্গুনী
মেঘকুয়াশায় খুঁজবো আলোর  চোখে
নদীর স্রোতে বৈয়বি ওতুই যক্ষনি
লাগবি ভেসেই আমার হৃদয়বুকে
একলা মনচাঁদ তুই আপন কর
হৃদয়েখুঁজে ফিরি তোর মনআদর 





নীহার রঞ্জন আদক

মারামারি

শুধু শুধু ঘুরে ফিরে তেল কেন মেরে যাও?
ঝোপ বুঝে কোপ মেরে মেরেছো তো বড় দাঁও।
বন্ধুকে ল্যাঙ মেরে প্রমোশন হাতালে
অফিসেতে ফাঁকি মেরে আজীবন কাটালে।

এত বড় চেষ্টাটা মাঠে মারা গেল তার।
সব টাকা মারা যাবে পাবো নাকো নিস্তার।
মেরে কেটে দু-কলম লেখাপড়া শিখলেই
কাজ ফেলে রোয়াকেতে গুলতানি মারবেই।

লাফ মেরে বাগানেতে ঢোকে সেই ছেলেটা
মালকোঁচা মেরে ছোটে বাগানের মালীটা।
লুকায় ঘাপটি মেরে গিয়ে এক কোণেতে
উঁকি মেরে খুঁজে তারে ধ'রে আনে কানেতে।

পুকুরটা মেরে দিয়ে সব মাছ ধরা চাই
ঝোল মেরে কালিয়াটা গায়ে-মাখা করা চাই।
পেটে শুধু কিল মেরে কতক্ষণ থাকা যায়!
খোঁচা মারা কথা শুনে গা যেমন জ্বলে যায়।

ভুল ক'রে গোঁসাঘরে খিল মেরে থেকো না
খিদেয় মরবে জ্বলে লাভ কিছু হবে না।
ইয়ারকি মেরো নাকো মনটাই ভালো নেই
ফাঁকি মেরে কাজ সারে লোকসান সবেতেই।

পিঠে ছুরি মারে কতো বিশ্বাসী লোকজন
দুধ মেরে ক্ষীর খায় এলে পালা-পার্বন।
মনমরা হ'য়ে কেন ব'সে থাকো বাপুরে
গুলি মারো ঐ সব ছোটখাটো ব্যাপারে।

চোখ মারা ব্যাপারটা গোলমেলে বড্ড
ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে মরে বোকাদের হদ্দ।
ফুর্তি মারতে হ'লে পকেটের জোর চাই
হাঁড়ি মেরে খেলে হয় চেহারাটা খোলতাই।

কি সহজ জাত মারা ওটা নাকি ঠুনকো
অর্গল দণ্ডকে বলে নাকি হুড়কো।
ভাত মারা সোজা নয় সৎপথে চ'ললে
দাঁড়ি যদি মারো তুমি তাহলেই ম'রলে।

কতকিছু মারামারি উঁকিঝুঁকি মারা হয়
গাঁজাতেও দম মেরে বুঁদ হ'য়ে ব'সে রয়।
ফোনেতে রিচার্জ নাকি টাকা দিয়ে মারা যায়।
সুযোগেতে পেলে দই নেপোরাই মেরে খায়।






এম এ সবুর

তুমি আসবে বলে

তুমি আসবে বলে
পাথরগুলো অপেক্ষায় ছিল,
গ্রথিত হবার অপেক্ষায়;

তুমি আসবে বলে
আকাউন্টগুলো অপেক্ষায় ছিল,
পনের লাখ ডিপোজিটের অপেক্ষায়;

তুমি আসবে বলে
দিনগুলো সব অপেক্ষায় ছিল,
আচ্ছে দিনের অপেক্ষায় ;

অথচ তুমি এলে
তাদের অনাদায়ী ঋণ মকুবের জন্য,
পুঁজি যাদের আকাশ ছুঁতে চায় ।



অতনু মানী

ইচ্ছা মৃত্যু 

অবিশ্বাসের একরাশ মেঘ আবদ্ধ করেছে
মাকড়শার জালে আটক জীবন
খরস্রোতা নদীর বুকের ভার-সহ্যসীমা পাড়
উদ্বায়ী ভালোবাসা, পদস্খলন, পুতুল নাচ সবই আছে
নেই শুধু আবেগের ডাক...
সারাজীবন ইছামৃত্যুর বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলেও
আজ অভিমন্যু।
অবসাদক্লিষ্ট মন, নিথর শরীরে পড়েছে শকুনের চোখ
বারবার ইচ্ছামৃত্যুর হাতছানি আজ...
কে জানে আগামী পা,শিশিরবিন্দু স্পর্শ করবে কিনা!
যাওয়ার আগে এটুকু কথা রাখতেই হবে ---
আমার আপনজন বলতে আমি নিজেই। 



সুদীপ ঘোষাল

অন্তরকথা

ভালোবাসা কি শেখার জিনিস
এই যে রাত ভালোবাসে চাঁদকে
পুরুষ সূর্য পুড়িয়ে খায় পৃথিবীর গর্ভজাতদের

যেমন পুড়ছো কলেজ জীবনের বিরহ
এই সবই  অহরহ পোড়াবাঁশি
একদিকে পুড়েছে রাধা...
আর একদিকে আয়ান ঘোষের পোড়াটা নজর এড়িয়ে অবস্থিত ঘরে ঘরে,নিষ্ঠুর প্রেমী ...

ওর তো একটাই অবলম্বন অথচ  বুকের ভিতরে ঋণাত্মক ধ্বনি...
এদিকে মালা পরে যদু  মধু,হৃদয় মানে না
ও ভালোবাসা একটা  অসুন্দর হেরে যাওয়া প্রেমিকের গান লেখো না ...

বিশ্বজিৎ

রিংটোন

আমরা এখন
খুব একটা কথা বলি না।
দেখাও হয় না,যখন তখন

তবুও চোখ বন্ধ করলে
আরও তীব্র হয়…
আমাদের ধারালো রিংটোন 



প্রসেনজিৎ দাস

একটা আশ্চর্য হাত

একটা আশ্চর্য হাত যেন বারবার জানান দিচ্ছিল
                    তাঁর অদৃশ্য উপস্থিতি।
আমার দুর্বল মুহূর্ত গুলো যেন
                     বারবার শুধরে দিচ্ছিল,
কঠিন সময়ের রুক্ষতাকে ঠেলে ;
                   যেন বারবার বইয়ে দিচ্ছিল
আনন্দের বন্যা।
                        একটা আশ্চর্য হাত!

যখন ভালোবাসার মানুষগুলো একএক করে
                         দূরে সরে সরে যাচ্ছিল,
বিষাদাশ্রু গড়িয়ে পড়ছিল কপোল বেয়ে,
                     সান্ত্বনা দেওয়ার মত ছিল না কেউ;
তখন হার না মানা হার পরিয়েছিল,
                      সেই আশ্চর্য অদৃশ্য হাত !



সুবীর সিনহা

আজও

পাহাড়ের কোলে ছোট এক গ্রাম,
সাদা-মাটা লোক, নেই তাই দাম,
সকালের চা'য়ে  চিনি জোটে কম,
অভাব প্রাচীর ঘেরে হরদম।

ছোটে টয় ট্রেন, কু ঝিকঝিক,
হয়নি যে চড়া, জীবনকে ধিক্!
ঘন কুয়াশা ঢেকে দেয় রোজ,
অধরা সুখের মেলেনা তো খোঁজ।

শহরের লোক ক্লান্তি মেটায়,
ফেলে জঞ্জাল ঘরে ফিরে যায় ....



সংস্কৃতি ব্যানার্জী

স্বপ্ন

একটা বিশ্বাসের দোড়গোড়ায়
আরেকটা বিশ্বাস ভাঙতে দেখেছি।
তবুও এগোচ্ছি,
শেষ সিঁড়িটার জন্য

শুনেছি ভোরের স্বপ্ন সত্যি হয়…



লক্ষ্মীকান্ত মণ্ডল

হেরিটেজ

না হয় অন্ধকার ঘিরে ধরেছে কেলি কদমকে, এই সুযোগটা কেন নেবে মেঘ? তবু নিয়েই নিল, লাল পাথরের চাঁই গুলো নিজে শরীর দেখালো, বুকের খাঁজে চেপে ধরল মাথা, পুবের সেই মাওবাদের জঙ্গল থেকে কয়েকটা বাজপাখি ডুলুং নদীর রেখা ধরে উড়ে চলল পশ্চিমে-
সুবল সরেনের হাতে মহুয়া বোতল - বলছে আবার লড়াই বাঁধবে,ওই যে ব্রিজের নিচে চল্লিশটা মুখ দিয়ে জল বেরোচ্ছে গলগল, ওর সাথে মিশে আছে শুকনো ঘামের গুঁড়ো, দেখছিস না- কেমন পাথরও গুঁড়ো হয়ে যাচ্ছে -- চান কর্ কিন্তু গভীরে যাস্ না- জানিস তো স্রোতের কোন পিরীত নেই-
এখন হেরিটেজ ভাষায় কথা বলছে জঙ্গল, পযসার বিনিময়ে নাভি দেখাচ্ছে চিলিকিয়া, বলছে দশ টাকায় কি আর দেখবি,  শালপাতার ছাই তো পাবি না আর-
শব্দ আসছে, মেঘ বাতাসের জড়াজড়ির শব্দ, স্রোতে ডুবে যাওয়া হাঁটু কোমরে আদিম টান, আমি বুক ডুবাতে চাই- কাঁধের শ্রম ধুইতে ধুইতে মোতিয়া বলল- তুর দেহটায় আকাশ নাই কেনে?
হেরিটেজের বানানো রঙিলার চকচকে পালিসে তখন হিসি করছে কয়েকটা হনুমান ----

গুচ্ছ কবিতা - হৈমন্তী বন্দ্যোপাধ্যায়

স্থানীয় প্রেম

ঘোলা সানগ্লাস, হাতে নিকোটিন।
বন্ধুর বাস, অপেক্ষাধীন।
জোনাকি ডাকছে পায়ের তলায়
স্তব্ধতা ডাকে, কখন কি হয়!
জাহাজ ভেবে প্রেমিকের বুক।
আসলে কফিন, ঠান্ডা চুমুক।
বন্দর পেরিয়ে ছেড়ে যাওয়া ধোঁয়া
মুখেতে কুলুপ, পাশাপাশি শোওয়া।
আমাদের ঘুম পায় প্রতিটা রাতে।
বিছানার ঘরে, শ্যাওলা তাতে।
চোখের ফোঁটা, জলের দরে
ভিজছে শরীর নোনা শহরে।
কত কথকতা, কিবোর্ড জুড়ে
চাপা ফরিয়াদ, গানের সুরে।
ঢোঁক গিলে খায়, ক্লান্ত প্রানে
পৃথিবীর রাত নামে চেনা দোকানে।


প্রেমের ভরসাটুকু

আমার আবার দামালপনায় ভরসা নেই।
মুঠো আদর চোখের নালিশ বর্ষণেই।
কেমন করে বাঁচছে সবাই চারদিকে?
আমি বরং শুভেচ্ছা দিই হার্দিকেই।
পলাশ ফুল আর কৃষ্ণচূড়ার অন্ত্যমিল,
আবহাওয়ায় আর্দ্রতা আর জলদিঘী।
ছবি আঁকা চলছে মনের পূবপানে,
ব্যস্ততা আর অবসরের মাঝখানে।
কারা যেন পাঠাচ্ছে সব প্রশ্নদের
চাইছে নাকি অশান্ত হোক আকাশ ফের?
তারচে' বরং চোখে প্রেমের স্তর পড়ুক,
ঠোঁটপাখিটার আবদারে হোক সুর শুরু।


কবিতা সম্মেলন 

বাইপাস। হোর্ডিং। ল্যাম্পপোস্ট।
শহরের জ্যাম থেকে শপিং মলের ভিড়
এসবের ভেতর দিয়ে আমি কবিতা শুনতে পাচ্ছি।
বিষয়বস্তু যাইহোক।
ভাতের হাঁড়ি খালি, চাল বাড়ন্ত।
ছোটোবেলায় মা'র কাছে শুনেছিলাম
চাল কমে এলে বাড়ন্ত বলতে হয়।
সেই খালি হাঁড়ির ভিতরেও একরাশ কাঁচাপাকা চুল- মাইক- মাথা- মাইক- ফুলের তোড়া -চেয়ার -ভারী কন্ঠস্বরের কবিতা শুনতে পাচ্ছি।
রাতে বিছানায় শুয়ে যখন আমিত্ব খোয়াচ্ছি
স্বামীসোহাগী হওয়ার প্রয়াসে,
জানলার তার দিয়ে ঠিক তখনই যা শুনতে পাচ্ছি সেসব ঝিঁঝিঁর ডাক নয়, কবিতাই।
অন্তত কবিতার মতো।
আমি একটা কবিতা সম্মেলনের ভেতর দিয়ে যাচ্ছি।
দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে ল্যাম্পপোস্ট আপাতত ক্লান্ত, হোর্ডিং ঝুলছে, বাইপাস ফাঁকা!
এসব ছাড়াও আমি কবিতা শুনতে পাচ্ছি।

মামুদ রায়হান

নদী নারী ও গাছ

চারদিকে অদ্ভুত অন্ধকার এক।
মাঝে মাঝে ঘুমের মধ্যে জেগে উঠি।
শ্বাপদের আনাগোনা বেড়েছে অনেক।।

গাছেরাও ভয় পায়, নদীও খোঁজে প্রিয়জন।
দিকে দিকে নারীমেধ যজ্ঞ।
আজ বৃষ্টির বড়ো প্রয়োজন।।

মননেও লেগেছে দূষণ উষ্ণায়ণের আঁচ।
এখনো জেগে ঘুমাবে নাকি?
এসো দুহাতে জড়িয়ে ধরি,নদী নারী ও গাছ।



ভাস্কর পাল

একজন ঈশ্বর ?

দীর্ঘ নীরবতার পর আবার কথা হলো
কথা হল অসম্ভব স্বপ্নের
নক্ষত্রের রাজত্ব হারানোর ব্যাথা বুকে নিয়ে
আগলে রাখা হয়নি
হাতুড়ির তুমুল শাসন ।
শব্দের ওপারে
একজন ভণ্ড?
একজন ঈশ্বর?
একজন সহজ কোনও মানুষ?
কেবলমাত্র তামাশার জন্য
পদদলিত মাটির এদিক সেদিক শায়িত রয়েছে
রক্তপূর্ণ আমাদের সাংবিধানিক শরীরগুলো ?
তাদের কাফন রক্তাক্ত ও ঠোঁটগুলো সিক্ত
রক্তকোষ চুম্বনরত ঠোঁটগুলো কখনো কখনো
অনুভব করে কর্তব্যরত সাম্য অস্ত্রের দীপ্তি
অনুভব করে প্রগলভ শোণিতের বিচ্ছুরিত উষ্ণতা
ক্ষরণের সময় কুশলী পেশিগুলোর  অনিয়ন্ত্রিত নিষ্পেষণে ।
আস্থা, যা মুছে দিতে পারতো আমার তোমার অতীতের সমস্ত দুঃখ
এবং তোমাকে মুক্তি দিতে পারতো সেই বন্দীত্ব থেকে
যার নাম দেয়া হয়েছে ধর্মপ্রেম
ভালোবাসতে সক্ষম তোমার সেই হৃদয়ের সন্দেহপ্রবণ বিশ্বাস থেকে
এবং পৃথক করতে পারতো অস্পষ্ট ধর্ম থেকে তোমার সগৌরব প্রত্যাহার
পৃথক করতে পারতো সেই কপট দৈব নির্দেশ আর
সেই ভেক রূপী ঈশ্বরদের দেহ সভ্যতা
আজও সমীকরণের দিকে চোখ, চেয়ে আছি
সভ্যতা তাকিয়ে আছে তার অন্তর্গত ক্ষয়
আর প্রশংসিত পচনের দিকে 

দুটি কবিতা - সুনীতা বিশ্বাস

তুমি ছিলে না......

তুমি ছিলে না তাই…....
কিছুটা সময় কেটেছে অবহেলায়।
তুমি ছিলে না তাই……
সময়ের স্রোতে ভেসে যাওয়া স্মৃতিরা অসহায়।
তুমি ছিলে না তাই......
গোধূলি বিকেলটা আজও তোমার অপেক্ষায়।
তুমি ছিলে না তাই......
মনের মন্দিরে জ্বলেনি প্রদীপ সন্ধ্যায়।
তুমি ছিলে না তাই......
মন আজও ভালো নেই বিষণ্ণতায়।
তুমি ছিলে না তাই......
স্বপ্নরা হারিয়েছে রাত জাগা চোখের পাতায়।
তুমি ছিলে না তাই......
একা মন শুধু খুঁজেছে তোমায়।
তুমি ছিলে না তাই......
থমকে গেছে জীবনের কিছুটা সময়।
তুমি ছিলে না তাই......
জীবনের রঙ গুলো ভরেছে বিবর্ণতায় ।
তুমি ছিলে না তাই.........
জীবনটা আজ বৃথা-ই।
তুমি ছিলে না তাই.........
মৃত্যুমুখী মনটা আজও তোমাকেই ফিরে পেতে চায়।


কি আর হবে অতো ভেবে

      কি আর হবে অতো ভেবে.........
     সময় যাবে আপন স্রোতে।
     ইচ্ছে গুলো হবে না পূরণ ,
          মিথ্যে শুধুই স্বপ্ন দেখা।

         কি আর হবে অতো ভেবে...
      দুঃখ গুলো রয়ে যাবে সুখের আশায় পথ চেয়ে,
      দিনের শেষে ফিরবে মন ক্লান্ত দুটি আঁখি নিয়ে।

          কি আর হবে অতো ভেবে......
         জীবনটা শেষ হবে আবেগে।
          আবেগ বিহীন শূন্য জীবন,
        মিথ্যে শুধুই বাড়ে প্রলোভন ।

    কি আর হবে অতো ভেবে......
    আপন যে ছিল সে তো পর -ই হবে।
   চেনা মানুষও অচেনাই রবে।
মনে রবে না তাই মায়া মমতা ভালোবাসা,
জীবনে বেড়ে চলে তাই টাকার লালসা।

কি আর হবে অতো ভেবে......
দুঃখ কষ্ট বাড়বে শুধুই,
বাড়বে শুধুই না পাওয়ার লিস্ট।
খুশির মুহূর্তরা যাচ্ছে হারিয়ে,
অতীত গুলো ভাবতে গিয়ে।

কি আর হবে অতো ভেবে......
জীবনটা তো যাবে ফুরিয়ে,
স্বপ্ন গুলো যাবে হারিয়ে।
জীবন যুদ্ধে জিততে গিয়ে হয়তো হবে পরাজয়,
মিথ্যে আবার সান্ত্বনাতে হতে হবে নির্ভয়।

কি আর হবে অতো ভেবে......
 ভাবনার আর নেই তো শেষ...
তাই কি আর হবে অতো ভেবে !

গল্প - সৌরভ হোসেন

পিছুটান

     শিয়ালদা স্টেশনে নেমেই প্রথম ফোনটা পেল সবদুল ।রিংটা ভাল বোঝা যাচ্ছিল না ।গ্যাঞ্জামে চাপা পড়ে যাচ্ছিল । থিকথিকে ভিড় ।হুড়মুড় করে লোক এদিক ওদিক ছুটছে । হুটপাট করে লোকে তাকে ঠেলে চলে যাচ্ছে । তার যাত্রাটাও বহু ঠেলার ফল । বেঁচে-টেচে, ধার-দেনা করে কোনরকমে বিমান ভাড়াটা জোগাড় হয়েছে । তারপর কাজের ভিসা পেতে দালালকে দিতে হয়েছে গুচ্ছের ঘুষ । কাজটা অবশ্য তার খুব পছন্দের । মক্কাশরিফ ঝাড়পুছ দেওয়া।মায়নেও ভাল।মাস গেলেই পনেরশো রিয়াল । অবসর সময়ে অন্য কোথাও ঠিকে কাজও করতে পারবে।সেক্ষেত্রেও দশ বারো হাজার টাকার উপরি ইনকাম।তাছাড়াও ছোট্টবেলা থেকে মিলাদ-মজলিসে শুনে এসেছে যে মক্কা-মদীনার কথা , সাহাবা আকরামদের কথা , আল্লার পিয়ারা নবী হযরত মহম্মদ , হাসান- হোসেনদের কথা , গায়ের লোম খাড়া করা গল্প-কাহানী , সেই পবিত্র ভূমিতে সে স-শরীরে হাঁটবে , শ্বাস নেবে , স্বচক্ষে সব দেখবে , ভাবতেই তার গা কাঁটা দিয়ে উঠছে । যদিও পিছুটান জব্বর পোক্ত । বাড়িতে মরণাপন্ন বিধবা মা । একমাত্র খাটনে পিঠাপিঠি বড় ভাই মইদুল । তার কাঁধেই সংসারের জোয়াল । সংসারের গুণ টানতে গিয়ে তার আর বিয়ে করা হয়ে ওঠেনি । খেটে-খুটে যা কিছু জমিয়ে ছিল , একমাত্র বোনটার বিয়ে দিতেই সব নিঃশেষ হয়ে গেছে । থাকার বাড়িটাও সেভাবে করে উঠতে পারেনি । ইটের দেওয়াল আর টালির ছাউনি দিয়ে কোনরকমে একটা মাথা গোঁজার ঠাঁই বানাতে পেরেছিল । মইদুলের অনেক দিনের ইচ্ছে ছোট ভাইকে সৌদি পাঠানো । ওখানে নাকি টাকা উড়ে বেড়াই ! গাঢ়ি গাঢ়ি টাকা । মইদুল এদিক ওদিক খোঁজ খবর নিয়ে দেখেছে, যেইই আরবে গেছে সেইই ফুলে ফেঁপে উঠছে ! বছর ঘুরতে না ঘুরতেই কাঁচা বাড়ি পাকা ! গাড়ি ! বাজারে জায়গা ! তারও একবার ইচ্ছে জেগেছিল । কিন্তু মরণাপন্ন মা’কে রেখে তার পক্ষে সে ইচ্ছে পূরণ করা সম্ভব হয়নি । অগত্যা ছোট ভাইয়ের মধ্যে দিয়েই নিজের ইচ্ছেপূরণ ।

“ ট্রেন থেকি নেমিছিস ?”  মোবাইলে মইদুলের থিতানো কণ্ঠের আওয়াজ ।

 “ হ্যাঁ , এইমাত্র নামনু । শিয়ালদা ।“  থড়বড় করে উত্তর দিল সবদুল ।

 “ ইয়ারপোর্টে ঠিক ভাবে যাতে পারবি তো ?”  মইদুলের কণ্ঠে আশঙ্কা !

“ হ্যাঁ ,হ্যাঁ ,কুনু অসুবিদা হবে না খ । ট্যাক্সি ধরি চলি যাব ।“ সবদুলের কথায় আত্মবিশ্বাস ঝরে পড়ে । আত্মবিশ্বাস থাকবেই বা না কেন ? কলকাতায় তো সবে আসছে না ? ঢের ক-বার এসেছে । রাজমিস্ত্রির জোগালের কাজ করেছে টানা তিন বছর । মাথায় ফেট্টি বেঁধে বাঁদুরের মতো ঝুলে বিশাল বিশাল অট্টালিকার সুউচ্চ ছাদ থেকে এ শহরটা তার দেখা ।

“ মা ক্যামুন আচে ? বুক জ্বালা পুড়াটা কি কমিচে ?”  মা-এর তোখিদ করে সবদুল । কণ্ঠস্বর ধোঁকাচ্ছে । পিঠে ঢাউস ব্যাগ ! থপথপ করে হাঁটছে । সামনেই ট্যাক্সি স্ট্যান্ড।

“হ্যাঁ , কমিচে । এখুন ভালো আচে । মা’র কথা তোকে চিন্তা কত্তে হবে না খ । আমরা তো আচি । তুই তাড়াতাড়ি ইয়ারপোর্ট চলি যা । লেট করিস ন্যা । উখানেই হাত-মুখ ধুয়ি আরাম লিবি ।“

মইদুলের কথা জড়িয়ে আসে । বুকের ভিতর থেকে কষ্টের দলা ঠেলে উঠছে । কিন্তু শক্ত মনের মানুষ মইদুল সে কষ্টকে কথাই মাখতে দেয়না ।

সবদুল ট্যাক্সি ভাড়া করল । চারটে পঁয়তিরিশ এ ফ্লাইট । সবে দেড়টা বাজল । ভাবল, ঠিকাদারকে একটা ফোন লাগায় । লোকটার এখন ইয়ারপোর্টে থাকার কথা ।

“ হ্যালো, আমি সবদুল বুলছি । আপনি কতি আছেন ? ও আচ্ছা । আমি আসচি। ট্যাক্সিতে।“

ফোনটা রেখে দিল সবদুল । সবকিছু ঠিকঠাক আছে । শুধু বাড়ির জন্য তার মনটা আনচান আনচান করছে । একটা পিছুটান তার জালি নাড়ি-ভূড়িকে কটকট করে কাটছে । নামলা সবদুল ভাবে, এভাবে কি মরণাপন্ন মা’কে বিছানায় ফেলে রেখে বিদেশ খাটতে যাওয়া ঠিক হল ? পরলোকে গিয়ে বাপটাকে কী কৈফৎ দেব ?

ট্যাক্সিটা যখন শহরের ব্যস্ত রাজপথ দিয়ে সাঁ সাঁ করে ছুটছে, সবদুলদের বাড়িতে তখন যমে মানুষে টানাটানি শুরু হয়েছে । কারিমন বেওয়ার খুটোল চোখগুলো ঢেলা হয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে ! মাঝে মাঝে ঝিকছেন । কাঁথার বিছানাটায় গড়াগড়ি দিচ্ছেন । তার পেট জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছে । ঘুষঘুষ করে শ্বাস নিচ্ছেন । যন্ত্রণাটা মাঝে মাঝে মারণ কামড় দিচ্ছে । খক খক করে কাশছেন দুমড়ানো শরীরের কারিমন । কফ-এর সাথে উঠছে রক্তের দলা ! ব্যামুটা আজ নতুন নয় । স্বামী মরা কারিমন গত আড়াই বছর ধরে ভুগছেন ! ফুসফুসের সংক্রমন । ডাক্তার সাফ বলে দিয়েছেন, বাঁচার সম্ভাবনা কম । ফুসফুসের অনেকটা অংশ নষ্ট হয়ে গেছে । লাঙ্কস ক্যান্সার !

ট্যাক্সিটা মুল ফটকের গা ঘেঁষে দাঁড়াল । দমদম নেতাজী ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট । কানে ভেসে আসছে বিমান ওঠানামার বিকট আওয়াজ । অজগাঁয়ের ছেলে সবদুলের সব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে ! নতুন জায়গা ! চোখ ধাঁধানো প্রবেশদ্বার ! সে শুনেছে এখানে অনেক ফ্যাচাং । ঘনঘন চেকিং । ঝটঝামেলা । প্রাইমারি পাশ সবদুলের কাছে এসব বুঝে ওঠা নাকে চুড়ুনের সামিল ! কপালে ঘাম চিকচিক করছে তার ! ঠিকাদারকে ফোন লাগাল সে । বলল, সে দুই নম্বর গেটে অপেক্ষা করছে ।

                                                দুই

 সব বন্দোবস্ত শেষ । ফ্লাইটের আর আধ ঘণ্টা দেরি । সবদুল মুঠোফোনটা বারবার ডায়াল করে যাচ্ছে । কিন্তু কেউই রিসিভ করছে না ! চোখে-মুখে বিরক্তির ছাপ । মাথায় ঠকঠক করছে দুশ্চিন্তার হাতুড় । মা’র কি কিছু হল ! যন্ত্রণাটা কি আরও বেড়ে গেল ! মা’কে কি সবাই হাসপাতাল নিয়ে গেছে ? নিশ্চয় সবাই খুব ব্যস্ত আছে । তানাহলে ফোন কেন ধরবে না ?

 সবদুলের চোখ ছলছল করে ওঠে । একেবারে মা পাগল ছেলে । গাঁয়ের লোকে বলে, ছুঁড়া ধারি বয়সেও মায়ের দুধ ছাড়েনি । একদণ্ডও মায়ের আঁচল ছাড়ত না । কারিমন যেখানে গেছেন কোল মোছা ছেলেটাকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতে হয়েছে । তানাহলে তার কাঁদন চুপানো যেত না । সেই ছেলে আজ ভিনদেশ পাড়ি দিচ্ছে ! একটু পরেই পাখির মতো ডানা মেলে বিমানটা আকাশে উড়ে যাবে । সবদুল কতদিন ভু ভু শব্দ শুনে উঠোনে ছুটে এসেছে । ঘাড় কাত করে উড়ে যেতে দেখেছে বিমান ।

সবদুল এবার ভিতরে ভিতরে ডুকরে উঠছে । যাকে পাচ্ছে তাকে ফোন লাগাচ্ছে । কিন্তু কেউই তার ফোন রিসিভ করছে না ! তার ধন্দটা আরও দানা বাঁধে ! আশঙ্কার মেঘে ঝড় ওঠে । নিশ্চয়ই কিছু অঘটন ঘটেছে ! সবাই ব্যাপারটাকে গোপন করতে চায়ছে । তবে কি মা….

 সবদুলের চোখ ফেটে জল আসে । অন্তরটা হু হু করে ওঠে । আচমকা হুট করে চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়ে । মনের মধ্যে জোর দন্দ শুরু হয় । আরব যাব, না যাব না ? এই ‘যাব’ আর ‘যাব না’ র মধ্যে জোর টক্কর বাঁধে । ওদিকে তাদের নুন আনতে পান্তা ফুরনোর দৈন্যদশার কথাও মনে ঘা দেয় । এত কষ্টের অর্জিত টাকার বিনিময়ে বিদেশ পাড়িটা হেলায় নষ্ট করলে সংসারটা ভেসে যাবে । এতগুলান টাকা জলে ফেলে কোন মুখে বাড়ি ঢুকবে ? তাছাড়া এলাকায় সেরকম কোন কাজও নেই !

একসময় টগবগ করে ফুটতে থাকা ঘেলুটা থির হয় সবদুলের । পরিবারের অভাব-অনটন আর দারিদ্রের কড়াল থাবা তার মনের দোটানাভাবকে দমিয়ে দেয় । বিদেশ পাড়িটাকেই শিলমোহর মারে । সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে ফ্লাইটেরও সময় হয়ে যায় । থড়বড় করে বিমানে উঠে বসে সবদুল । তারপর একসময় বিমান রানওয়ে ধরে ছুটতে ছুটতে টেকঅফ করে ।

                                                  তিন

 বিমানবন্দরের ওয়েটিং রুমে অপেক্ষা করছিলেন কপিলের ( ঠিকাদার ) লোক । সবদুল আগে থেকে ঠিক করে দেওয়া সংকেত ধরে তার সঙ্গে দেখা করে । লোকটা তাকে সঙ্গ নেন । লোকটার পরনে আরবিয়ান বেশভুষা । গায়ে জোব্বা । মাথায় ফেট্টি । লম্বা হাংড়াচাংড়া চেহারা । লোকটা আরবিতে কী সব ফদফদ করে বলে যাচ্ছেন । সবদুল ওসব কিচ্ছু কান করছে না । তার মাথায় এঁটে আছে তার মা । ছ-ঘণ্টার বিমান জার্নিতে তার মাথায় আঁকড়ে ছিল তার রোগগ্রস্ত মা ।মায়ের যন্ত্রণাক্লিষ্ট মুখ । তাদের লিচিনপুরের বাড়ি । নিকানো উঠোন । কান্টার সজিনা গাছ । মায়ের হাতের রুটি । বেগুন পোড়া ভাত । বালুনে ভাজা মুড়ি । দিঘড়ি দেওয়া ছাগল ।

সবদুল লোকটাকে আকার-ইঙ্গিতে বুঝিয়ে  তার কাছ থেকে মোবাইলটা বাগায় । ফটাফট বাড়ির নম্বরে ফোন লাগায় । দু-বার লম্বা রিং বেজে ফোনটা কেটে যায় । মইদুলের হাতে মোবাইল । অথচ রিসিভ করে না । সে কোড নম্বর দেখে বুঝে নেয়, এটা সৌদির ফোন । নিশ্চয় সবদুল । বাড়িতে তখন কান্নার ধুমায়িত স্বর । মইদুল ঠাহর করে, ফোনটা এখানে রিসিভ করা ঠিক হবে না । সে গটগট করে পা চালিয়ে পাশের ক্ষেতের নিরিবিলি জায়গায় যায় । মোবাইলটায় তখন চতুর্থবারের মতো লম্বা রিং হচ্ছে । একেবারে শেষলগ্নে ফোনটা রিসিভ করে মইদুল ।

“ হ্যালো ।“

বড়ভাই-এর কণ্ঠস্বরটা শুনে ধড়ে প্রাণ ফিরে আসে সবদুলের ।

“ তুমাদের কাহুকে ফোনে পাচ্ছিন্যা ক্যানে ?”

সবদুলের গলায় আক্ষেপ ঝরে পড়ে ।

“ ফোনটা সাইলেন্ট হয়ি গেছিল রে । যাইহোক, তুই ঠিকঠাক পৌঁছেছিস তো ?”

কথাটার মোড় ঘোরানোর চেষ্টা করে মইদুল । ভাঙা কণ্ঠস্বর ।

“ মা ক্যামুন আছে ?” জানতে চায় সবদুল ।

“ ভালই আছে ।“ অল্প কথায় উত্তর দেয় মইদুল । কথা ভারি হয়ে আসে তার ।

“ তুমার কি ঠাণ্ডা লেগিছে ? কথা বসা ক্যানে ?”

“ হ্যাঁ রে, একটু ঠাণ্ডা লেগিছে । সদ্দি হয়িছে । তুই এখন কতি আছিস ?”

“ ইয়ারপোর্টে ।“

“ কুম্পানির লোক কি লিতে এসছে ?”

“ হ্যাঁ, এসছে ।“

‘ ও, তাহলি পরে, তুই অ্যাখুন উনার সাতে যা । গিয়ি, গোজগাছ করি, ফেস হয়ি, ফোন করিস ।“

“ মা’কে একটু ফোনটা দ্যাও ?”

“ মা, মা তো অ্যাখুন বাড়িতে নাই ! কার বাড়ি য্যানো গ্যালো । তুই পরে ফোন করিস ।“

কথাটা শেষ করেই ফোনটা রেখে দেয় মইদুল । দু-চোখে জোর করে আটকে রাখা অশ্রু এবার বাঁধ ভাঙে । গাল চুঁইয়ে টসটস করে ঝরে পড়ে । ভিতরে ভিতরে গোমরায় ফোঁপানির চাপা স্বর ।

                                                       চার

   রাত দশটা । মুঠোফোনটার স্ক্রিন জ্বলে উঠল । বুঁ বুঁ করে কাঁপছে মুঠোফোনটা । মইদুল ঘাড় ঘুরিয়ে কোড দেখে বুঝল, সৌদির ফোন । নিশ্চয় সবদুল ।

“ হ্যাঁ, বুল । সব ঠিকঠাক আছে । তুই ভালো আছিস তো ?”

“ মা’কে ফোনটা দাও ভাই । মা’র সাতে কথা বুলতে খুউব ইচ্ছে করছে ।“

“ মা তো অ্যাখুন ঘুমাচ্ছে রে । ব্যারাম শরিল । ঘুম ভাঙানো ঠিক হবে না ।“

 ঘুমের বাহনা দেয় মইদুল ।

সবদুল ভাবে, তাই তো ? এখানেই তো ছটা বাজছে । ইন্ডিয়াতে অ্যাখুন রাত দশটা এগারোটা । মেল্লা রাত ! থাক, সকালেই ফোন করব ।

সকালে ঘুম থেকে উঠে উঠেই ফোন লাগায় সবদুল । মইদুল ইচ্ছে করে ফোনটা রিসিভ করে না । এবার সত্যি সত্যি সাইলেন্ট মুডে রেখে দেয় । সবদুল বারকয়েক ডায়াল করার পর কিছুক্ষণের জন্য বিরত হয় । তবু ক্ষান্ত হয় না । এবার সে আরিফাবুবুর ফোনে ফোন করে । আরিফা তাদের একমাত্র বোন । সাতসকালে ফোন বাজতে দেখে আরিফার ভিতরটা ধড়াক করে ওঠে । আবার কারও কিছু হল নাকি ! নতুন নাম্বার দেখে, কার ফোন বুঝতে পারে না সে ।

“ হ্যালো, কে বুলছেন ?”

“ বুবু, আমি সবদুল বুলছি ।“

“ সবদুল !”

নামটা মুখ দিয়ে বেরিয়েই দম আটকে যায় আরিফার । কান্নার মেঘ ফেটে পড়ার সামিল হয় । নাকে-মুখে আঁচলা ঠেসেঠুসে কোনরকমে নিজেকে সামলে নেয় । ভাঙাস্বরে জোর করে বাতাস ঠেলে আমতা আমতা করে বলে,

“ তুই ভালো আছিস তো ? কাজ ঠিকঠাক পেয়েছিস তো ? থাকার জাগাডা ক্যামুন ? যারতার সাতে মিশবি ন্যা । কারু পাল্লায় পড়বি ন্যা । মুন দিয়ি কাজ করবি । ঠিকিদারের কথা শুনবি ।“

ভড়ভড় করে বকে যায় আরিফা । কী বলে সে নিজেই জানে না । তার কথার মাঝে দাড়ি পরায় সবদুল—

“ মা ক্যামুন আছে গো ?”

আর কথা বের হয়না আরিফার । ‘থ’ মেরে যায় । নাকটা একবার জোরে সুড়ুৎ করে টানে । আঁচল দিয়ে চোখদুটো দল্লে মোছে । তারপর একবার আলতো করে গলা ঝাড়া দিয়ে বলে—

“ মা তো আগের থেকি ভালই আছে । দিব্যি হেঁটি চলি ব্যাঁড়াচ্ছে ।