২৫ মার্চ ২০১৭

নীহার রঞ্জন আদক

কুলতলির মউল

আমি তখন ক্লাস থ্রীতে ড়ি, বয়স সাত কিম্বা আট বছর আমাদের অল্প কিছু চাষের জমি ছিল বাবা প্রাথমিক স্কুলে শিক্ষকতা রতেন এবং অল্প জমির চাষ দেখাশোনা রতেন এর জন্য কৃষি শ্রমিকও প্রয়োজন তো সেই বছর ধান কাটার সময় দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা থেকে কয়েক জন কৃষি শ্রমিক এলো তাদের মধ্যে একজনকে রাখা আমাদের বাড়ীতে সে অধর চন্দ্র সর্দার বাড়ী কুলতলি থানার একটা গণ্ড গ্রামে বাড়ীতে আছে তার তিনটি বাচ্ছা, স্ত্রী এবং বিধবা মা বাড়ীতে থেকে খাওয়া দাওয়া রে চাষের কাজ করার জন্য তাকে রাখা তার কাজ নির্ধারিত য়েছিল ধান কেটে তোলার সময় থেকে আলু লাগানো এবং আলু তোলার পর তিল বোনার সময় পর্যন্ত অর্থাৎ অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি থেকে মার্চ মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত এর পর সে বাড়ী লে যাবে এবং আবার আসবে ধান কাটার সময় তার মজুরি এলাকার শ্রমিকদের তখনকার মজুরীর থেকে কিছুটা কম বাড়ীর বাইরে একটা বাইরের ঘর ছিল সেই ঘরটাই ছিল অধরের থাকার জায়গা সারাদিনের কাজের ব্যস্ততার মধ্যেও আমার প্রতি তার এক নিগূঢ় ভালোবাসা আমাকে এতটাই আকৃষ্ট করেছিল যে আমি সর্বদাই তার কাছে কাছে থাকতে লাগলাম তার সন্তানদের সান্নিধ্য-বঞ্চিত পিতৃত্ব নতুন রে রে উঠেছিল অপত্য স্নেহে গান গল্পে রে তুলতো আমার সারাটাক্ষণ তার গল্প বলার ভঙ্গিটা ছিল অনবদ্য আর রাখালিয়া গানের গলাটাও ছিল খুব সুন্দর আমিও য়ে উঠেছিলাম তার খুবই নেওটা সেই অধর জ্যেঠুর গল্পের আকর্ষণ আমার কাছে দুর্নিবার মায়ের কাছে বায়না ধরলাম অধর জ্যেঠুর কাছে রাতে থাকবো লে বাবা মা বাধ্য লেন আমার আবদার রক্ষা রতে সেদিন থেকে অনুমতি পেলাম জ্যেঠুর কাছে রাতে থাকার এবং গল্প শোনার নানান রূপকথার গল্প এবং পুরাণের গল্প শুনতে শুনতে আমি হারিয়ে যেতাম কোন এক আজানা জগতে প্রত্যেকদিন ভোরবেলায় তার গলা-ছাড়া প্রভাতী গান একটা অদ্ভুত পরিবেশ সৃষ্টি রতো এবং সকলকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলতো জমিতে কাজ না থাকলে, বাড়ীতে সে দড়ি পাকানো, চাটাই বোনা, পাপোষ বানানো ইত্যাদি বিভিন্ন কাজ সে করতো কখনো সে থাকতো না খড় দিয়ে দড়ি পাকিয়ে আমার জন্য একটা দোলনাও তৈরি করেছিল সে আর এই সব বৈঠকি কাজের সাথে চলত তার গান কিম্বা গল্প বলা প্রায়ই তার গল্পে উঠে আসতো তার জঙ্গলের জীবনের কথা গল্পে গল্পে সে প্রায়ই শোনাত, কেমন করে তারা দল বেঁধে জঙ্গলে গিয়ে মধু সংগ্রহ রতো, কেমন রে কাঠ সংগ্রহ রতো, কেমন রে মাছ রে নিয়ে আসতো, আরও কতো কিছু আর শোনাত কেমন রে মাঝে মাঝে হরিণ শিকার রতো এবং কখনো বা কেমন ভাবে বাঘের মুখোমুখি য়েও বেঁচে ফিরেছে সে শোনাত, দল বেঁধে জঙ্গলে গিয়ে কখনো বা দলের কাউকে হারিয়ে কতো গভীর বেদনা নিয়ে বাড়ী ফিরেছে তারা এই ভাবে পর পর তিন বছর সে এসেছিল পরের বছর নির্ধারিত সময়ে সকলেই অনেক অপেক্ষা রে থাকার পরও অধর জ্যেঠু এলো না মনের মধ্যে কিরকম একটা শূন্যতা অনুভূত তে লাগল অনেক দিন অপেক্ষার পর সকলেই ভাবল, হয়তো তার বাড়ীতে কোনো কাজ পড়েছে তাই হয়তো এবছর আসেনি, পরের বছর নিশ্চয়ই আসবে কিন্তু জানা গেল সে বছর তাদের গ্রাম থেকে আরও যারা আসতো, তারা কেউই আসেনি সকলে ভাবল এবছর নিশ্চয়ই তাদের এলাকায় ভালো কাজের সুযোগ য়েছে, তাই তারা আসেনি আমি মনে মনে ভাবতে লাগলাম এখন হয়তো কোনও অসুবিধা য়েছে, কিছুদিন পরে নিশ্চয়ই আসবে অপেক্ষার ভার বাড়তে লাগলো কিন্তু অধর জ্যেঠু সে বছর এল না

পরের বছর সেই সময়টি এসে গেল আমার মনে আশার ঝিলিক খেলতে শুরু করলো একদিন জানা গেল কুলতলির সেই গ্রাম থেকে অনেক লোকই এসেছে ছুটে গিয়ে তাদের কাছে জানতে ইচ্ছে করছিল, অধর জ্যেঠু কবে আসবে কিন্তু তারা যাদের বাড়ীতে থাকতো তাদের বাড়ী বেশ দূরে, তাই আমার পক্ষে তা করা সম্ভবপর ছিল না বাড়ীর সকলেই তার খবর জানতে উদ্গ্রীব হয়ে ছিল তাই বাবা একদিন অধরের গ্রামের একটি লোকের সঙ্গে দেখা রে খবর জানতে গেলেন জানতে পারলেন, গত বছর আমাদের বাড়ীতে জঙ্গলের মধু নিয়ে আসবে লে জঙ্গলে মধু সংগ্রহ করতে গিয়েছিল অধর জ্যেঠু আর ফিরতে পারেনি তাকে বাঘে ধরে নিয়ে গেছে ঘটনা শোনার পর সারা বাড়ী ঘিরে বেশ কয়েকদিন ধরে একটা নিদারুণ নিস্তব্ধতা ছেয়ে গেল আমার বুকের ভেতরটা চিন চিন করে উঠল মনে এখুনি হয়তো বা বুকের ভেতর নিংড়ে হৃদপিণ্ডটা থেকে রক্তের শেষ বিন্দু পর্যন্ত বেরিয়ে আসবে কিছুটা বড় য়ে যখন সমাজ, অর্থনীতি, বাংলার গ্রাম্য জীবনের মানুষ জনের আর্থিক অবস্থা ইত্যাদি সম্বন্ধে কিছুটা ধারণা , তখন বুঝতে শিখলাম, সমাজের মানুষের দুঃখ দুর্দশার কথা বুঝতে শিখলাম, কোন অসহায় অবস্থায় ড়লে একজন মানুষ জীবনের অতগুলো দিন নিজের সন্তান সন্ততি পরিবার পরিজনকে ছেড়ে বাইরে থাকে মাত্র কটা টাকার জন্য, যে টাকায় তার নিজেরই হয়তো ভালভাবে দিন গুজরান হবে না আজ আমি পঞ্চাশোর্ধ বয়সে পৌঁছেছি, এখনও সেদিনের অধর জ্যেঠুকে ভুলতে পারিনি অনুভব রি তার পরিবার পরিজন তথা সন্তান সন্ততিদের দুঃখ দুর্দশার কথা চোখ ঝাপসা হয়ে ওঠে আজও যখন গ্রামে-গঞ্জে, মাঠে-ঘাটে, হাটে-বাজারে জীর্ণ-শীর্ণ মানুষ জনকে দেখি, তাদের মধ্যে দেখতে পাই অধর জ্যেঠুকে মনটা ভারাক্রান্ত য়ে ওঠে এখনও প্রায়শঃই চোখের সামনে ভেসে ওঠে সেদিনের সেই মধুর স্বভাবের অধর জ্যেঠুর স্পষ্ট ছবি প্রায়শঃই হয়ে উঠি অত্যন্ত নস্টাল্জিক অনেক সময়ই পোঁছে যাই অধর জ্যেঠুর বলা সেদিনের গল্পের কথা চিত্রের জগতে চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে ওঠে অধর জ্যেঠুর গল্পের ক্যানভাসে আঁকা ছবিগুলো



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন