০৬ এপ্রিল ২০১৪

গল্প- জাকিয়া জেসমিন যুথী


কাঁচা-মিঠা বন্ধুত্ব অথবা ক্ষোভের গল্প 




ক্যান্টিনের এক প্রান্ত রিফাত, রাখি, ইশরা, পারভিন আর জ্যোতি বসে আছে সবার মধ্যে চাপা উত্তেজনা ! পারভিন রাগে ফুঁসছে কিছুক্ষণ আগে নোটিশ বোর্ডে রেজাল্ট দেখার পর থেকেই পারভিনের মেজাজ খারাপ !
পারভিনঃ আমি বুঝি না, কি এমন লেখে যে ওর প্রত্যেকবারই আশির উপরে নাম্বার আসে ? আর কারোই আসে না কেন? আর কেউই কি ভালো লেখে না?
জ্যোতিঃ পারভিন আপা, এত রাগ করতেছেন কেন? বাদ দেন তো!
পারভিনঃ আমাদের মতন বাচ্চাকাচ্চা নিয়া নিশু সংসার করতো স্কুলে থাকতো সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত অর মতন বাচ্চা কাচ্চা সব বাসায় ফেলায় আইসা সারাদিন ভার্সিটিতে পরে থাকতাম তো আমরাও পারতাম ওর মতন নাম্বার তুলতে
রিফাতঃ আরে বাদ দাও তো দুদিনের জন্য ভার্সিটি এসেছি একটা ফার্স্ট ক্লাস জুটে গেলেই শান্তি
ইশরাঃ ঢাকা ভার্সিটির ডিগ্রি বলে কথা যেকোন একটা কিছু পেলেই চলে কারো সাতে পাঁচে আমি নাই
এর পরে ইশরা হাত ঘড়িতে সময় দেখলো সন্ধ্যা সাতটা পঞ্চাশ পেরিয়ে গেছেএই আপা, চা তো খাওয়া হইছে চলেন চলেন, ক্লাসে দেরীতে ঢুকলে লেকচার মিস হয়ে যাবে
পারভিনঃতুমি যাও আমার জন্য জায়গা রাইখো
ইশরা, রিফাত আর রাখি হন্তদন্ত হয়ে ব্যাগ কাঁধে নিয়ে ছুটলো এক তলার ক্যান্টিন থেকে তিনতলার উদ্দেশ্যে মঈন চৌধুরী স্যারের ভালনারেবল ম্যানেজমেন্ট ক্লাস বিষয়টা নতুন এসেছে এর কোন বই বেরোয়নি ক্লাস লেকচারই ভরসা তার উপরে স্যারটা বেশ বয়স্ক কথা জড়িয়ে যায় নিজে ক্লাসে উপস্থিত না থাকলে অন্যের কাছ থেকে লেকচার নিয়েও কোন উপকার হয় না
তিন তলায় উঠে দেখে স্যার আগে আগে হেঁটে চলেছেন ক্লাসরুমের দিকে তা দেখে ইশরা ওর বন্ধুরা স্বস্তি পেলোযাক, লেকচারটা শুরু থেকেই পাওয়া যাবে
স্যার ঢুকলেন সামনের দরজা দিয়ে আর ওরা গিয়ে পেছনের দরজা দিয়ে ঢুকে একেবারে প্রথম সারির কোণায় গিয়ে বসলো ইশরা ওর পাশের চেয়ারে ওর ব্যাগটা রেখে খাতা বের করে নিজে লিখতে থাকলো কিছুক্ষণ পরে ক্যান্টিন থেকে এলো বাকিরা পারভিন এসে বসে গেলো ইশরার ব্যাগ রাখা চেয়ারে



ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মহসীন হলের মসজিদের কাছে তিনটা টং ঘর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছাত্রছাত্রীরা এখানে চা নাশতা খায়
নিশাত, রুমা, জুঁই আর ইশরা একটা বেঞ্চে বসে আছে জুঁই ছাড়া বাকীদের হাতে নুডলসের হাফ প্লেট জুঁই চা খাচ্ছে দুধ চা
জুঁইঃ মামার এখানে দুধ চা-টা এত্ত টেস্টি হয়! বাসার চা না ইদানিং একটুও মজা লাগে না!
এই সময় সামনে এসে উপস্থিত হলো মোটু ছোটখাটো সোয়া পাঁচ ফুটের উচ্চতার ছেলেটার বিশাল একটা ভুড়ির কারণে বন্ধুরা সবাই ওকে রোমানের বদলে মোটু বলেই ডাকে ওটাই এখন ওর নাম হয়ে গেছে ওকে খুব উত্তেজিত মনে হলো যেন হাঁপাতে হাঁপাতে এসেছে সে বলে উঠলো, “, আর খাইয়ো না এই চা!”
জুঁই বলে উঠলো, “ক্যান? কি হইছে? আর তুই এমন হাঁপাচ্ছিস কেন?”
আরে, তোমরা জানো নাআআ?” রোমান এখনো হাঁপাচ্ছে!
জুঁই বলে উঠলো, “এই! কি হয়েছে রে তোর?”
নিশু আপা খুব অসুস্থ! জানো কি হইছে? ওনার তো এই চা খাইয়াই...” মোটুটা অনবরত হাঁপাচ্ছেই!
বিপদের গন্ধ পেয়েই এইবার হাত থেকে আধা খাওয়া চায়ের গ্লাসটা নামিয়ে রাখলো জুঁই
বাকি সব জনও উঠে দাঁড়ালো ক্লাসের সময় হয়ে যাচ্ছে যা খেয়েছে তার বিল পরিশোধ করে দিলো আর বিশ মিনিট পরেই পরের ক্লাস সবাই আইইআর ক্যাম্পাসের দিকে হাঁটা ধরলো আর যেতে যেতে মোটুর কাছে শুনতে থাকলো আগাগোড়া কাহিনী


যেখানেই কোন ঘটনা সেখানেই যেন জুঁই রহস্যের গন্ধ পায় আর একটু আধটু লেখালেখি করে বলে যেখানে সেখানে গল্পের প্লট খুঁজতে শুরু করে মোটুর ওরকম হন্তদন্ত হয়ে ছুঁটে আসা আর কাহিনী বর্ণনার পরে ওর কেন যেন মনে হতে লাগলো আটত্রিশ ছাড়িয়ে গেলেও চনমনে তরুণীর মতো শারীরিক-মানসিকভাবে উদ্যমী নিশু আপার আচমকা এই অসুস্থতার পেছনে কোন গভীর কারণ রয়েছে হতে পারে এর পেছনে জড়িত রয়েছে ওনার ভালো রেজাল্ট প্রত্যেকবার ডিপার্টমেন্টের সব বিষয়ে এমনকি ইডি বিষয়গুলোতেও উনি কিভাবে -প্লাস মার্ক্স রাখেন এটাই বোধহয় কারো কাছে অসহ্য হইয়ে উঠেছে!
সামনের সপ্তাহ থেকে তৃতীয় পর্বের ফাইনাল শুরু সেমিস্টার ভিত্তিক পড়াশুনায় কোন ছুটিই পাওয়া যায় না রিলাক্স করার কোন চান্স থাকে না একটা টার্ম শেষ হওয়ার সাথে সাথেই আবার পুরোদমে নতুন টার্মের ক্লাস শুরু হয়ে যায় তারপরে টুক করে টিউটোরিয়াল পরীক্ষা, ক্লাস প্রেজেন্টেশন, এসাইনমেন্ট একেবারে জীবনটা ছাড়খাড় করে দিতে শুরু করে

জুঁই, ইশরা, মোটু এই তিন জন একরকম না পড়ুয়া দলের শিক্ষার্থী এরা শুধু ভার্সিটি আসে এক সাথে বসে নিয়মিত ক্লাস লেকচার শুনে ভার্সিটির প্রফেসরদের কাছে খুবই চেনা সিরিয়াস মুখ হিসেবে পরিচিত কিন্তু বাসায় ফিরে বই খাতা নিয়ে নাড়াচাড়া করে না এরা নিজেরাই নিজেদের দলের নাম দিয়েছে থ্রী-ইডিয়টস! দলের মধ্যে ইশরা আর মোটু সারাক্ষণ ঝগড়া করে শান্তশিষ্ট স্বভাবের মেয়ে ইশরাকে মোটু সারাক্ষণ ক্ষেপায় আর জুঁই পড়াশুনা না করেও কিভাবে কিভাবে যেন এদের মধ্যে বেশি নাম্বারটা পেয়েই যায় জুঁই আর মোটুর পাশাপাশি রোল ওরা একই ডিপার্টমেন্টের সামাজিক বিজ্ঞান শিক্ষা আর ইশরা সায়েন্স ডিপার্টমেন্টের ছাত্রী ওর নাম্বারও ভালো থাকে যেখানে কিছু কিছু ক্লাসে কোন লেকচারই তুলে না বাচ্চাদের মতো করে খাতায় নোটের মতো সব সাজিয়ে রাখতে নাকি ওর খুবই বিরক্তি লাগে! চাকরি সংসার সামলিয়ে ভার্সিটিতে এসেছে এটাই নাকি বেশি! কিভাবে যে পরীক্ষার খাতায় লিখে তা বলতে পারবে এদের মধ্যে মোটু কিছুটা সিরিয়াস পরীক্ষার দিনটিতে অন্তত স্কুল থেকে ছুটি নিয়ে ভার্সিটির লাইব্রেরীতে বসে সকাল থেকে বিকাল পরীক্ষার রুমে ঢোকার আগে পর্যন্ত পড়তেই থাকে
ইশরাও মোটুর স্কুলেরই কৃষি বিজ্ঞানের শিক্ষক ওর তিন বছর বয়সী একটা মেয়ে আছে সারাদিন বিকেল পর্যন্ত স্কুলে ডিউটি দিয়ে সেখান থেকে ভার্সিটিতে নাইটের এমএড ক্লাস শেষ করে টিকাটুলির বাসায় পৌঁছতে রাতের ঘুমোবার সময় হয়ে যায় তার উপরে সারাদিনে বাচ্চা মেয়েটাকে সময় না দেয়ার কারণে বই নিয়ে বসার আর সুযোগই হয় না পরীক্ষা এলে ইশরা আর জুঁই পড়তে বসে বিকেল সাড়ে পাঁচটায় পরীক্ষার হলে ঢুকবার ঘন্টাখানেক আগে টং ঘরে চা খেতে খেতে এটাই হয়ে এসেছে গত দুই টার্ম আর বদমাইশ মোটুটা একই স্কুলে চাকরী করা সত্বেও ইশরার ঘাড়ে নাইন-টেনের ক্লাস নেয়ার দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়ে মাঝেমাঝেই স্কুল কামাই করে সকাল থেকে লাইব্রেরীতে পড়াশুনা করে আল্লাহও বুঝি এভাবেই বিচার করে! ইশরা পড়াশুনা করার সুযোগ না পেয়েও পঁচাত্তর সাতাত্তর নাম্বার পায় আর মোটু সবসময় সত্তরের নিচেই থাকে


ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ চাদর বিছিয়ে শীত নেমেছে বিশ্ব চরাচরে
এমএড তৃতীয় পর্বের ফাইনাল পরীক্ষা শুরু হচ্ছে আজ থেকে এবার আগের দুই টার্মের মতো মোট পাঁচটি বিষয়ে পরীক্ষা দেওয়া ছাড়াও পুরো এক বছরে পড়া আটটি ইডি বিষয়ের উপরে অবজেকটিভ পরীক্ষা দিতে হবে সেই সাথে পাঁচটি ডিপার্টমেন্টাল বিষয়ের রিভাইজ হিসেবে রিটেন এবং ভাইভা আছে এই সব বিষয়ে আলাদা আলাদা পাশ না তুলতে পারলে সার্টিফিকেটই নাকি দিবে না এই কথা শুনে এই টার্মে পড়ুয়া অপড়ুয়া সকলেই পড়াশুনা করা শুরু করেছে এতদিনের হেসে খেলে বেড়ানো ইশরা আর জুঁইয়েরও টনক নড়েছে এইবার তারা কিছুটা সিরিয়াস অবশ্য জুঁই সবসময়েই সিরিয়াস ওর ভাবসাবে সব সময় না পড়ুয়া ভাব থাকলেও পরীক্ষার প্রশ্ন দেখেই যে খাতায় লেখা শুরুর আগেই বলে দেয় বিষয়ে কত নাম্বার তুলতে পারবে আর দেখা যায় ঠিক ঠিক ওই নাম্বারটাই তুলে ফেলেছে তাকে সিরিয়াস না বলে উপায় আছে!
মংগলবার বিকেল সাড়ে চারটা
জুঁই ভার্সিটিতে পৌঁছেই ইশরাকে কল দিলো- “কি রে, তোরা দুইটা কই বইসা রইছোস?”
আমি আছি ক্যান্টিনে মোটু কই জানি না মনে হয় নিশু আপার সাথে পড়া দেখতেছে!” খুব বিরক্তির স্বরে জবাব দিলো ইশরা
খাড়া, আইতাছি!”
রিকশা ভাড়া মিটিয়ে দিয়েই ইশরা ছুটলো ক্যান্টিনের দিকে একতলার কোণার দিকে আইইআর ক্যান্টিন
ইশরার কন্ঠের সুর ওর ভালো লাগেনি সামথিং ইজ ভেরি ভেরি রং!
ভেতরে ঢুকে ঠিকই দেখলো, ইশরার চোখেমুখে রাজ্যের বিরক্তি! “কি রে, শীতের বিকেলে বর্ষার ঘনঘটা?” জিজ্ঞেস করে জুঁই
আর কইস না! কি কর্তে যে এইখানে এমএড করতে আসছিলাম আমার আর ভাল্লাগে না!”
ক্যান? কি হইছে আবার?”
আরে, মোটুডা! আমারে অর স্কুলে চাকরী দিয়া আমার মাথাডা কিননা ফালাইছে! স্কুলে ইচ্ছা মতন আমারে খাটায়! যখন তখন সুযোগ পাইলেই অর ক্লাস আমারে গছায় দ্যায়! এমনকি জেএসসি পিএসসি কোচিঙের ক্লাসও আমারে ধরায় দিয়া কি সুন্দর লাইব্রেরীতে আইসা সকাল থিকা পড়তে থাকে! আর আমি যে বাসায় বাচ্চাডারে সময় দেই অরতো আর আমার মতন বাসায় সময় দেয়া লাগে না অর বউ যে কি করে তা অই জানে তারপরে সকাল থিকা স্কুলে ক্লাস নেই তারপরে আমার কি আর পড়াশুনা করার দরকার পরে না? আজকের পরীক্ষায় তো আমি কিছুই পারুম না!” এক নিঃশ্বাসে ঝড়ের গতিতে কান্না, রাগ আর ক্ষোভের কন্ঠে উত্তেজিত স্বরে কথাগুলো বলে যায় ইশরা

জুঁই বলে উঠে, “তুই বলেই সহ্য করছিস! আমি হলে মুখের উপরে বলে স্কুল থেকে ছুটি নিয়ে চলে আসতাম! তুই অনেক বেশি সহ্য করিস!”
তার উপরে এখন আবার আমার কাছে আমার এসাইনমেন্টটাও চাইতেছে! কয়-জমা দেয়ার আগে আমারে এট্টু দিও আমি ফটোকপি কইরা নিবো নে আর একটু চেঞ্জ কইরা দেবো নে টেনশন কইরো না!”
জুঁই বলে উঠলো, “দেখি তোর এসাইনমেন্টটা
ইশরা সেটা বের করে দিতেই সেটা খুলে দেখে নিয়ে নিজের ব্যাগের ভেতরে ঢুকিয়ে রাখলো আর বললো, “তোর জমা দেয়া হয়ে গেছে! বলে দিস কে!”
আল্লা জুঁই, নিস না! আমারে স্কুলে আরো জ্বালাইবো!” ইশরা টেনশনে পরে যায়
জুঁই বলে উঠে- “শোন, এভয়েড তুই যে সরাসরি করতে পারবি না তা আমি জানি তুই শুধু ওকে বলে দিবি, ওটা জুঁইয়ের কাছে আছে! বাকিটা আমি সামলাবো
কি বলবি তুই?”
আমি কি বলবো সেটা আমার উপরে ছেড়ে দিয়ে আরাম করে বস আর আমার খাতাটা নিয়ে একটু পরে দ্যাখ! আজকের তোর আর আমার তো একই বিষয় সিট বোধহয় কাছাকাছিই পড়বে আমি প্রশ্নোত্তর দেখাবোনে তোকে একটু হাসি দে এইবার আর মাথাটা ঠান্ডা কর!”
এতক্ষণে ক্ষোভে রাগে মোটুকে একটা শক্ত মাইর দিতে ইচ্ছে করতেছিলো কিন্তু সেটা করতে না পারার বৃথা আস্ফালনে ইশরার মাথার তার ছিঁড়ে যাওয়ার উপক্রম হচ্ছিলো এখন জুঁইয়ের বুদ্ধি শুনে মাথাটা সত্যিই ঠান্ডা হয়ে গেলো আর জুঁইয়ের প্রতি কৃতজ্ঞতায় চোখে পানি এসে গেলো জুঁই আবার দেখে ফেলার আগেই সেটা গোপন করে নিলো মুখে হাসি টেনে বলে উঠলো, “বলো বন্ধু, কি খাইবা?”
জুঁইয়ের প্রতি পুনরায় ওকে আবেগে ভাসতে হলো যখন দেখলো জুঁই ব্যাগে করে মাসকলাই ডাল দিয়ে রান্না করা পোলাউ চালের খিচুড়ি আর কৈ মাছের ঝোল টিফিন বাটিতে করে নিয়ে এসেছে ওর জন্যে
নে খা! এইসব পুরি, পেঁয়াজু এক-দুটা খেয়ে তিন ঘন্টার পরীক্ষা দেয়া যায়? আম্মা তোর জন্যে পাঠিয়ে দিলো
জুঁই সাদা রঙের ছোট পোলার বাক্সটা একটা প্লাস্টিকের চা চামচ সহ ওর দিকে এগিয়ে দেয় বাধ্য হয়ে ছোট মেয়ের মতো ওকে সেটা জুঁইয়ের সামনেই শেষ করতে হয় নইলে মেয়েটা ওকে বকে আর আস্ত রাখবে না আর জানা কথা এটা না খেলে সেই রাত দশটা সাড়ে দশটা পর্যন্ত ওকে ক্ষুধা পেটেই থাকতে হবে
 
পর পর কয়েকটা পরীক্ষা দেয়ার ব্যস্ততায় নিশু আপা অসুস্থতা কিংবা মোটুর এসাইনমেন্টের ভাবনা কোনটা নিয়েই আর ভাবার সময় পায়নি জুঁই
এক সন্ধ্যায় বাসায় বসে আছে জুঁই মোটুর কল পেলোএই ব্যাটা তো ফোন টোন দেয় না! ঘটনা কি?” ভাবতে ভাবতে কল রিসিভ করলো না জুঁই সাথে সাথে ইশরাও কল দিলো জুঁই রিসিভ করতেই বলে উঠলো, “ওই, মোটু তোরে কল দিছিলো?”
-
!
-
আমার কাছেও কল দিছিলো মনে হয় এসাইনমেন্ট চায়! কি করুম?
-
! তরে না কইছি ওরে আমার কথা কবি!
-
আচ্ছা, বন্ধু তাইলে রাখি
পরের দিন জুঁই ভার্সিটিতে ঢুকতেই মোটুর সাথে দেখা- “এই! তোমরা কি এসাইনমেন্ট লিখছো?”
-
কোন্ এসাইনমেন্ট?
-
যে সাইকোলজির!
-
ঐটা তুই এখনো লিখোস নাই? জমা দেয়ার শেষ তারিখ তো আজকেই!
-
! দেই নাই ভাবলাম তুমি তো আছোই
-
আমি আছি কিন্তু, তুই তো আমারে কস নাই যে তর ওইটা লাগবো
-
আমারে তো একটু জিগাইলাও না!
-
মা! ফাইনাল পরীক্ষার ব্যস্ততা আছে না? এইবার আমি পড়াশুনা নিয়া সত্যি ব্যস্ত! তাই ভুইলাই গেছি!
-
! জমা দিছো?
-
আমি তো ইশরারটা সহ পরীক্ষা শুরুর আগেই জমা দিয়া দিছি!
-
ওহ!

আজকে জুঁইয়ের প্রস্তুতি অনেকটাই ভালো এদিকে চা খাওয়ার জন্যে ক্যাম্পাসের ক্যান্টিনও খোলা পেলো না অবশেষে অনেক দিন পরে টং দোকানে গেলো চায়ের জন্য সেই যে নিশু আপার অসুস্থতার খবর পেয়ে টং ছেড়েছিলো তার পরে পনেরো বিশ দিন পেরিয়ে গেছে
আজকে মোটুও টঙে চা খেতে বসলো কিছুক্ষণ পরেই ইশরা এসে হাজির যত ঝগড়াই হোক ঘুরে ফিরে তিনটা এক জায়গাতেই আসে
জুঁই ভাবলো নিশু আপার খবরটা জিজ্ঞেস করে মোটুর দিকে তাকিয়ে বললো, - “কি রে, তোর নিশু আপা যেন কি জন্য অসুস্থ হয়ে গেছিলো?”
-
আরে , ঐটা আর বইলো না! বদরুল স্যারের ক্লাসে পারভিন আপা ঐদিন লাড্ডু খাওয়াইছিলো আমিও খাইছিলাম আর কারও কিছু হইলো না নিশু আপা বমি টমি কইরা অস্থির!
-
তুই যে কইলি টঙের চা খাইয়া বলে ওইরকম হইছে!
-
আরে সেইটা তো তোমাদের সাথে ইয়ার্কি করছিলাম
-
মানে কি?
-
কিছু না! চা খাও তো!

চা আর ডিম বন খাওয়ার পরে বিল না দিয়েই কিছুক্ষণ পরে মোটু উঠে হাঁটা দিলো ক্যাম্পাসের দিকে
আর কিছুটা এগিয়ে গেলে সেদিকে তাকিয়ে থেকে জুঁইকে ইশরা বলে উঠলো, “আরে তরে আর আমারে শান্তিতে মিল্লা মিশ্যা এক জায়গায় বইসা থাকতে দ্যাখলেই তো অর কলিজা পুড়ে! দ্যাখোস না, আমারে চাকরি দিছে দেইখা খালি আমার উপর দিয়া অর খাওয়ার বিলটাও উঠায় নেয়! কবে যে অর উশুল তোলা শ্যাশ হইবো!” ইশরা আবার ক্ষেপে যেতে থাকে
জুঁই তখন ফোড়ন কেটে বলে উঠে- “ন্যাও দোস্ত! এত যে ক্ষ্যাপো, তারপরেও তো দেখি, একসাথে স্কুল থিকা এক রিকশায় যাতায়াত করো দুইজনে! আবার রাইতেও দুইজনে এক লগেই রিকশাত কইরা বাড়িত ফিরো
ইশরা আবারো ফুঁসে উঠে রাগে, “আর কইস না! এত্ত জ্বালায় আমারে! যেদিন ওর আর আমার এক লগে ক্লাস শেষ হয় সেইদিন আমার ক্লাসরুমের সামনে আইসা আমার জন্যে খাড়ায় থাকে আমার সাথে রিকশায় উঠতে পারলে তো ওর ভাড়া বাঁইচ্চা যায়! বুঝোনা?”
মানা করলেই পারোছ!”
দোস্ত! আমি মানা করতে পারি না একদমই ব্যাটা এমন চশমখোর! যেদিন দেখবি ওর ক্লাস আগে শ্যাশ হইয়া যায় সেদিন আর আমার লাইগা খাড়ায় না! ঠিকই ওইদিন অন্য কারো লগে চইলা যায়! একবার কইয়াও যায় না যে অর ক্লাস শেষ!”

লালবাগ জামিলা খাতুন উচ্চ বিদ্যালয়ে রোমান চাকরি করতো গত পাঁচ বছর ধরে সেখানে একটা সায়েন্সের টিচার প্রয়োজন পরেছিলো স্বামীছাড়া এক মেয়ের মা ইশরার তখন একটা চাকরির খুব প্রয়োজন দুইয়ে দুইয়ে চার মিলে গেলো কিন্তু গোল বাঁধলো যখন ইশরার চাকরিটা বছর না ঘুরতেই অস্থায়ী থেকে স্থায়ী হলো এবং সেই সাথে বেতনটাও চার হাজার থেকে বেড়ে এগারো হাজার হয়ে গেলো আর মোটু রয়ে গেলো সেই পুরনো চার হাজার বেতনে অস্থায়ী পদেই তখন বন্ধুকে বেশি বেতনে দেখে দেখে নিজের হাতে দেয়া ইশরার চাকরীটার জন্য ওর আফসোস হতে থাকে আর যখনই সুযোগ পায় সেটা উশুল উঠাতে চায় সে রাগের বহিঃপ্রকাশ এভাবেই ঘটে যেতে থাকে দিনের পর দিন এর চেয়ে বুঝি বা একসাথে মোটা অংকের টাকা ঘুষ হিসেবে দিয়ে দিলেও শান্তি মিলতো ইশরার

জুঁই আর কি বলবে! জানে, এই দুইটা এইরকমই থাকবে ইশরা যেমন মোটুর উপরে ক্ষেপে থাকে, তেমনি কোথাও গেলে ওটাকে ফোন করে ডেকে না আনলে শান্তি পায় না শুধু এই দুইটাই নয়, এই তিন বন্ধু তো এইরকমই এই ঝগড়া! এই মিল! কখনো হাসি ঠাট্টায় মিলে রয়েছে এক সাথে কখনো এক সাথে সিনেমা দেখতে যাচ্ছে বিশেষ করে দুইটা-ইশরা আর মোটু ইশরা দিলখোলা হাতে মোটুর জন্য খরচ করতেই থাকবে আর তারপরে যত ঝাল জায়গামত না ঝেড়ে জুঁইয়ের সাথে প্যানপ্যান করতে থাকবে আর জুঁইকে ব্যস্ত থাকতে হবে দুইটার ঝগড়ার মীমাংসাতেই বার বার যতবার ওরা কাঁচা মিঠা খুনসুটিতে জড়াতেই থাকবে





কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন