০৪ অক্টোবর ২০১৭

গল্প - আজিজা নাসরিন

প্রতিশোধ

পুরানো বাড়ি ছেড়ে সবে নতুন বাড়িতে আমরা তখন এসেছি | জায়গাটা আসলে ছোট্ট মফসসল | আমাদের আগের বাড়ি ছিল এখানে থেকে দুটো গ্রাম পরে |এই মফসসলে বাবার ছোট্ট একটা ডিস্পেন্সারী আছে, আর তাছাড়া এই বাড়ি থেকে আমার কলেজ আর বুনুর স্কুল খুব কাছেই বলা যায় |নতুন বাড়িটা বেশ সুন্দর ছোটোর উপরে | দুটো বড় বড় বেডরুম | রান্নাঘর আর তার পাশেই একটা টানা বারান্দা |বারান্দা থেকে নেমেই উঠোন, উঠোনের একপাশে কলতলা আর স্নানের ঘর | আর একপাশে শৌচাগার | আমাদের পাশে একটা বাড়ি তারপর বেশ কিছুটা ফাঁকা জায়গা... তারপর মূল পাড়া শুরু হয়েছে | আসলে এখানে সবে নতুন বাড়ি শুরু হয়েছে তাই পাড়ার মাঝে মাঝে বেশ কিছু ফাকা জায়গা পড়ে আছে |বিকালে এগুলোতে বাচ্চারা খেলতে আসে |পাড়ায় সেভাবে কারো সাথে আলাপ হয়নি.... আর তাছাড়া কিছুদিন পর বুঝতে পারলাম আমাদের বাড়ির পাশের বাড়িটায় কেউ থাকে না, বাড়ির লোকজন শহরে থাকে, কালে ভদ্রে আসে এখানে | বাড়িটায় গাছপালায় ভর্তি |আমি আর বুনু যে ঘরে থাকি সেখান থেকে রাত্রিবেলায় জানালা দিয়ে বাড়িটার বারান্দা দেখা যায়, অন্ধকারে কেমন যেন আমাদের গা ছমছম করে, তবুও কেউ কাউকে কিছু বলি না | হঠাৎ করে কখনও কুকুর ডেকে উঠলে কিন্তু সত্যিই খুব ভয় লাগে |আমার বাবা সকালে ডিস্পেন্সারীতে চলে যায় সেই রাত ৯ টায় আসে |সন্ধ্যাবেলা টুকু মা রান্না ঘরে ব্যস্ত থাকে আর আমি আর বুনু বইয়ের পাতায় মুখ গুঁজে থাকি, তবুও জানালা দিয়ে বাইরে চোখ চলে যায় মাঝে মাঝে | মাকে আবার ভয়ের কথা বলাই যায় না.... মায়ের মতে এসব হল আবল তাবল সিরিয়াল দেখার ফল | এভাবেই চলছিল আমাদের দিনগুলি |তারপর এমনি এক সন্ধ্যায় আমি আর বুনু পড়তে বসেছি.... হঠাৎ দেখি বুনু দারুণ চিৎকার করে উঠল,বুনু জানালা দিয়ে হাত দেখাল.... আমি ওর হাত অনুসরন করে দেখি কেউ যেন উঠোনে সাদা শাড়ী মেলে রেখে গেছে |আমি বাকরুদ্ধ |বুনুকে নিয়ে আমি রান্নাঘরে ছুটলাম | মাকে বলতেই মা তো খুব রেগে গেলেন "কেউ হয়ত বাড়িতে এসেছে কিংবা তোমাদের বানানো গল্প"  | মা আমাদের নিয়ে ঘরে এলো, আশ্চর্য্য!! শাড়ী উধাও | কিন্তু সত্যি যে আমরা দেখেছি | বাড়িটাও অন্ধকার প্রতিদিনের মত, মানুষের কোন চিহ্ন পাওয়া গেল না |আবার মায়ের কাছে বকা খেলাম |
রাত তখন ১০ টা, সবাই খেতে বসেছি একসাথে, পাশের বাড়ির উঠোনে দুম দাম শব্দ হতে লাগল |সবাই জানালায় গিয়ে দেখি... তালগাছ থেকে কিছু যেন কেউ ছুঁড়ে দিচ্ছে উঠোনে |মা সঙ্গে সঙ্গে জানালা বন্ধ করে দিলেন |আমার বাবা যথেষ্ঠ সাহসী, বাবা বললেন ব্যাপারটা বাইরে বেরিয়ে দেখে আসবেন, মা কিছুতেই যেতে দিলেন না |আর আমাদের দু বোনের অবস্থা তখন দেখার মত.... ঠক ঠক করে কাঁপছি |
তারপর আরো দুদিন গেল এভাবে, রাতে আমরা মায়ের সাথে ঘুমাই এখন, ভয়ে সিঁটিতেই থাকি |তারপর বাবা আমাদের সবথেকে কাছের এক প্রতিবেশীর বাড়ি গিয়ে ব্যাপারটা জানান |তারপর তাদের কাছে যা শুনলাম অবাক হওয়ার মত |

পাড়ায় ব্যানার্জী বাড়ির লোকেরায় সবথেকে পুরাতন এ পাড়ায় |ব্যানার্জী দাদু বয়:জেষ্ঠ লোক, তাঁর স্ত্রী, দুই ছেলে এবং তাদের দুই বউ আর নাতি নাতনি নিয়ে সংসার |এই বাড়ির লোকেদের অদভুত স্বভাব হল অন্যকে অযথা ভয় দেখিয়ে, অথবা ঠকিয়ে তাঁরা খুব মজা পান |পাড়ায় প্রায় সবার সাথেই এমন কিছু না কিছু করেইছেন | এই শুনে আমরা বিস্ময়ে হতবাক |সুতরাং এই দাঁড়াল যে তাঁরাই আমাদের ভয় দেখিয়েছেন এতদিন | পৃথিবীতে মানুষের চারিত্র‍্যিক এ হেন বৈশিষ্ট্যও যে থাকতে পারে তা আমার কল্পনার বাইরে ছিল |
যাইহোক আমার বাবা এ ব্যাপারে তাঁদের সাথে কথা বলতে যান এবং তাঁরা স্বীকারও করেন | ব্যানার্জী দাদু বরং এক চোট হেসে নিয়ে বললেন " হা হা হা, তা কেমন ভয় পেলে বলো "? আমার বাবা যথেষ্ঠ অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন, বললেন " বাড়িতে ছোট ছোট মেয়ে নিয়ে থাকি, ওরা তো ভীষণ ভয় পেয়েছে, এভাবে ভয় দেখানো কি উচিত হল বলুন? "
-আরে বাবা, ভয়ের কি আছে? তাছাড়া ভূত বলে কি কিছু আছে নাকি?
..........বাবা কিছুক্ষণ পর বললেন "অবশ্যই আছে, আপনি বিশ্বাস করেননা?
ব্যানার্জী দাদু ভীষণ অবাক হলেন |এরকম উত্তর তিনি আশা করেননি | বললেন"  সে কি হে, এই সভ্যতা তে এসেও ভূতের অস্তত্বে বিশ্বাস করো? হা হা হা "
-অবশ্যই,
-তা বিশ্বাস টা কি শুধুই বিশ্বাস নাকি কোন প্রমাণ আছে?
বেশ তাচ্ছিল্যের স্বরেই বললেন কথাটা,
-হুম আমি যদি আপনাকে ভূত দেখাতে পারি, তবে কি বিশ্বাস করবেন?
দাদু হকচকিয়ে গেলেন, বললেন "তাই নাকি, আচ্ছা কবে?
-পরের অমাবস্যায় |আমারদের বাড়িতে |

আমার বাবা যে ভূত দেখাতে ওস্তাদ তা আমাদের কস্মিনকালেও জানা ছিল না | সেদিন অমাবস্যার রাতে যথারীতি ওই দাদু তার ছেলে বউ নিয়ে হাজির আর হাজির গ্রামের কিছু উৎসুক লোকজন | আমরা অনেকেই ছোটরা ছিলাম, তারা তো মনে মনে ভীষণ ভয় পাচ্ছি, কিন্তু ব্যপারটা চাক্ষুষ দেখার লোভও সামলাতে পারছি না | যদি বাবা মা জানতে পারে আমরা ভয় পেয়েছি তাহলেই অন্য কোথাও আমাদের সরিয়ে দেবে | মায়ের আঁচল চেপে বসে আছি আমরা দুইবোন | মাও আমাদের মতই সমান উৎকন্ঠা নিয়ে অপেক্ষা করছে | রাত ১০ টা বাজল ঘড়িতে | আমার বাবা দাদুদের ফ্যামিলির সবাইকে একটা ঘরে ডাকলেন তার সাথে কিছু অন্য লোকও গেল যারা ভূত দেখতে ইচ্ছুক | ঘরের মাঝে একটা মোমবাতি জ্বলছে,বাবা সবাইকে ডেকে একটা করে লাইন করে বসিয়ে দিলেন | তারপর হাতে একটা ছোট্ট মাটির পাত্র | বাবা এবার মোমবাতি টা নিবিয়ে দিলেন, তারপর সবার হাতে হাতে গঙ্গাজল দিয়ে বললেন সেটা হাতে মুখে ভালো করে মেখে নিতে, পরে কিছুক্ষণ সংস্কৃত কিছু শ্লোক আউড়ে নিয়ে জানালা টা একটু ফাঁক করে ঘরের কোণে রাখা বড় আয়নায়ার সামনে মোমবাতি টা জ্বালালেন |তারপর একে একে সবাইকে আয়নার সামনে এসে ভূত দর্শন করতে বললেন | আমরা সবাই ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে ঘামছি, হৃৎপিন্ডের দ্রুত কার্যকারিতা সবকিছু যেন একে অপরের টা শুনতে পাচ্ছি | এবার ভিতরে একে একে সবাই আয়নার সামনে যাচ্ছে আর চিৎকার করে উঠছে..... না ভূত দেখে নয়, নিজের মুখ দেখে | দাদুর বাড়ির সবাইকে আমার বাবা গঙ্গাজল এর বদলে দিয়েছিলেন আলতা, এটা যে আমার আর বোনের সবুজ ঝুড়িটা থেকে চুরি করা সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই, আর বাকি দের কপালে গঙ্গাজল নয় আমাদের কলের জল জুটেছিল | তাদের সবার লালমুখ কিছুটা স্তম্ভিত, অবাক আর কিছুটা লজ্জ্বিতও বোধহয় হয়েছিল | পাড়ার লোকের মুখে মিটি মিটি হাসি, দাদু শুধু বলেছিলেন "এই ভাবে ঠকালে হে?"  বাবার মুখে নির্লজ্জ্বের হাসি | যাক গে, তারপর তাঁরা অনেকদিন আমাদের এড়িয়ে চলেছিলেন, পরে আবার স্বাভাবিক হয়ে যান অবশ্য, তবে পাড়ায় আসা নতুনদের কাউকে আর ভয় বা ঠাট্টা তামাশা করার সাহস দেখাননি |




কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন