০২ সেপ্টেম্বর ২০১৭

গল্প - আজিজা নাসরিন

সুধাকে আমি দেখিনি

সকালে উঠে স্নান করে যখন সুধা ফুল তুলতে যায় বাগানে, সকালের নরম রোদ তার চুলে ঝিকমিকিয়ে ওঠে | না, সুধার পায়ে মল বাজে না, তার ফর্সা নরম পা যেন নিজেই আনন্দে ঝমঝমিয়ে চলে | বাগানে এদিক ওদিক ছুটে ছুটে যখন সে ফুল তোলে, গাছের পাতাও তার সাথে নেচে ওঠে । চারদিকে যেন তাদের করতালি বেজে ওঠে | বাতাসে সুধার চুল এলো হয়, কখনও কপালের বিন্দু বিন্দু ঘামে আটকে থাকে কিছু চুল | না সুধা টিপ পরে না,পরলে না জানি তাকে আরো কত সুন্দর লাগত | পরনের কাপড়টা সাদা, সেই সাদা স্নিগ্ধতার সাদা নয়, ভয়ংকর সাদা, স্বামীর অকালমৃত্যুর অন্ধকারের সাদা | তা সেই সুধা কে আমি দেখিনি | আমি বেশ কল্পনা করে নিই সে কখনও কখনও বিকেলবেলা আনমনে খোলা জানালায় এসে দাঁড়ায়, কখনও সে খুব বক বক করে, আবার কখনও বই হাতে চুপি চুপি উঠে যায় চিলে কোঠায়, হয়ত দুপুরে ঘুম জড়িয়ে আসে তার, পাশে বই পড়ে থাকে, সুধার ঘুমন্ত মুখখানি হয়ত সেই "রাজকন্যা পুষ্পবতী"র মত লাগে | আমি ঠিক জানি না, কারণ সুধাকে আমি দেখিনি কখনও, তবে পড়েছি | ছেলেটার নাম দিবাকর, গ্রামের স্কুলের মাস্টার, সুধার বাগানের পাশের জানালার পড়শি | চুপি চুপি সুধার সমস্ত ছেলেমানুষির সাক্ষী সে | সুধা কখনও লক্ষ্য করেনি দুটো চোখ তাকে বেঁধে রাখছে দিন দিন, সে লক্ষ্য করেনি লম্বা ফর্সা, লাজুক ছেলেটার ডায়েরির পাতায় কবে সে জায়গা করে নিয়েছে | তারপর দিন যায় দিন আসে, মেয়েমানুষ তো সে, ঠিক ধরা পড়ে যায় দিবাকর সুধার কাছে | সুধার কাছে কাঠগড়ায় তাকে দাঁড়াতে হয়নি, তবে সে ভেবেছিল এই বুঝি গল্পের শেষ এসে গেল | সুধা পালিয়ে যায়নি, সুধা জবাবদিহি চায়নি তবে তার চোখ মাঝে মাঝে খুঁজেছে দিবাকরকে | এবার চলে লুকোচুরি, গল্পরাজ্যের লুকোচুরি | সেদিন সুধা খুব ভিজেছিল, বৃষ্টির প্রতিটি ফোঁটায় সে ভিজেছিল, তার ভেজা মুখের মিষ্টতা, আর কম্পিত ঠোঁটের কোমলতা দিবাকরকে লুকিয়ে থাকতে দেয়নি | আমি সেই সুধাকে শুধু কল্পনা করতে পারি, তার ছবি আঁকতে ঠিক পারি না, কারণ সুধাকে আমি দেখিনি | দিবাকর সুধার কোমল হাতখানি ধরে বলেছিল "ভালোবাসি, ভালোবাসি" | সুধার বে-রঙিন জীবনে লাল রং ছড়িয়ে দিল কেউ | মুখ লজ্জ্বায় রাঙা হল | পরেরদিন থেকে ফুল তুলতে সঙ্গী হল দিবাকর | দুজনের হাজার গল্পের মাঝে ফুল তোলার সময় আর হয় না গাছের ফুল শুকিয়ে যায় বাতাস জোরে আসে, গাছপালা আগের মতই হাততালি দেয়, সুধা লজ্জ্বা পায়, খুব তাড়াতাড়ি ফুল তুলে বেরিয়ে আসে | আশেপাশের লোকজনের চোখ এড়ায় না | সুধার ফুল তোলা বন্ধ হয় | সুধা আর আগের মত হাসে না,মুখ শুকিয়ে আসে, চোখের তোলায় কালি পড়ে, কানে আসে "বিধবা মেয়ের রংতামাশা ভালোর লক্ষণ নয়" | সেদিন দিবাকর এসেছিল সুধাকে নিতে,তাকে আপন করতে, সবাই তাকে ফিরিয়ে দিয়েছিল | দুদিন পর সুধার ঘরে আগুন লেগেছিল, পুড়ে ছাই হয়েছিল সুধা, ঘরের পিছনে কেরসিনের ড্রামটা এখনো হয়ত পড়ে আছে, অপরাধী ধরা পড়েনি, কিন্তু তারা সংখ্যায় কজন ? একজন, দুজন নাকি গোটা সমাজ ?
দিবাকর জানালায় উঁকি দেয় আজও, যদি কখনও সে আসে ফুল তুলতে, তার পাতায় পাতায় সুধার গল্প আজও সে লেখে | সুধার ফুলের মতো দেহটার পুড়ে ছাই হওয়ার কল্পনা আমার আসে না, কারণ সুধাকে আমি দেখিনি, ওই ‘চরিত্রহীন’ সুধাকে আমি কখনোই দেখিনি | 








কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন