শিক্ষা নিয়ে মশকরা
প্রথমে কিছু শব্দের উপর নজর দেওয়া যাক–– শিক্ষা, বিদ্যা, জ্ঞান এবং তারপর চাকরি। সমীকরণটা খুব একটা বেমানান নয় তাই না? কারণ, আমরা ছোটবেলা থেকেই শিক্ষা অর্জন করতে শুরু করলাম, তারথেকে এল বিদ্যা এবং আমরা টুপটাপ এক একটা তথাকথিত বিদ্বানে পরিনত হলাম। আর আমাদের ভারতীয় সমাজ তো পারসেন্টেজ দেখেই বিদ্যার বিচার করতে ভালবাসে। তাই কোনো না কোনো ভাবে চাকরিও পেয়েই যাই আমরা। এর পর তো নিজেকে সোশাল রিফরমার ভাবতে কেউই পিছপা নই, তাই না? কিন্তু ওহে রিফরমার, তোমার শিক্ষা, বিদ্যা, চাকরি সবই তো হল মাঝখান থেকে জ্ঞানটা হল কই? তুমি জ্ঞানী নও অথচ বিদ্যান!হাসালে বাওয়া..!
যে দেশে পরীক্ষার নম্বরের ভিত্তি তে যোগ্যতার বিচার করা হয় সেই দেশে জাত দেখে মানুষ বিচার করা টা তো খুব একটা অস্বাভাবিক কিছু না। সবকিছুই যদি উপরটা দেখে বিচার করা যেত তাহলে তো মাকাল ফলের কদর আরও বাড়ার কথা...।
তবে বাবা বিদ্বান, সব দোষ তোমার একার নয়, সমাজে আরও যারা বিদ্যোৎসাহী রয়েছেন তাদেরও বলিহারি! বলি কি, শিক্ষাব্যবস্থাটা কি আপনাদের জনকসম্পত্তি যে তা নিয়ে যেমন ‘খুশি তেমন সাজাও’ খেলা করছেন?
জানেন তো, বাজারে অনেক বইপত্র আছে। জ্ঞানের বই। কিন্তু আপনার ছেলে-মেয়েকে তো আবার একজ্যামের নোট মুখস্ত করতে হবে যে... স্যার যে অনেক নোট লিখিয়েছেন।- “টেক্সট বা অন্য বই পড়বি কখন বাবা, নাম্বারটা যে কমে যাবে...”!
কী বলুন তাই না? বাবা আপনার নাম্বার কম পাবে, চাকরি পাবে না! ভবিষ্যৎ যে তার একেবারে.../ ঘুটঘুট করছে অন্ধকারে। তাই নোট করো, নোট পড় আর নোট কামাও। বিন্দাস লাইফ!
দেশ ও রাজ্যের কিছু নামজাদা বিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয়, যেখানে সুযোগ পাবার জন্য ছাত্র-ছাত্রীরা এক্কেবারে মরিয়া, সেখানেও কী না শিক্ষা ও পরীক্ষা ব্যবস্থা নোট ভিত্তিক! টেক্সট পড়বার সুযোগ থাকলেও উপায় নেই। কেননা নোটের পর নোটের বোঝা মাথায় এসে পড়ছে আর নজর রাখতে হচ্ছে ৯০%-এর দিকে।
আসলে আমাদের শিক্ষাবিশারদরা অর্জিত গুণ হিসেবে এটা জেনেই থাকেন যে প্রাথমিক স্তরের সতেরো-ইঞ্চির একটা সারি থেকে ৮জন স্টুডেন্ট যখন টারসিয়ারি স্তরের বেঞ্চিতে বসতে যাবে, তখন তারা ৮জন থেকে ৪ জনে পরিণত হবে।এর মাঝখানে অনেকেরই সফর সমাপ্ত হবে নানা কারনে। সুতরাং তারা জানেন যে ভারতে ‘সর্ব শিক্ষা’(ক্লাস-১ থেকে ক্লাস-৮)সবার জন্য হলেও উচ্চশিক্ষা সবার জন্য নয়।
যদি সাম্প্রতিক কালের সাহিত্য পাঠক্রমের অন্তর্ভুক্তই না হল, তবে কী আজকের তাবড় তাবড় সাহিত্যিকরা লিখে চলেছেন অবসর প্রাপ্ত বৃদ্ধ আর আগামী প্রজন্মের জন্য? বর্তমান প্রজন্মের ছাত্র-ছাত্রীরা সেই সবকিছু থেকে দূরে থাকবে? আমাদের বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রেও বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথ, শরৎ, মাণিক, জীবনানন্দ ছাড়া যেন আর কেউ লিখতেই জানেন না; মাধ্যমিক থেকে উচ্চতর স্নাতক পর্যায়ের পাঠক্রম নির্নয়ের সময় এমন ভাবেই বর্তমান লেখকদের অবজ্ঞা করে দূরে সরিয়ে রাখা হচ্ছে।
বর্তমান পরিচালকবর্গের টনক নড়লেও মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরে বাংলা, ইতিহাস, ভূগোল, বিজ্ঞান বিষয়ক সেইসব গুরুগম্ভীর আলোচনা কে গল্পের ছলে এমন লঘু করে দেওয়া হচ্ছে যা কিশোর-কিশোরীদের সদ্য যুক্তিনির্ভর হয়ে ওঠা মানসিক পরিনতির পরিপন্থী। পনেরো-ষোলো বছর বয়সেও যেন বাচ্চা বাচ্চা ভাব নিয়ে পড়াশোনা করতে বসেছে তারা।
তবে ব্যতিক্রমী ছাত্রছাত্রী যারা আছে তারা এই পাঠক্রমকে একরকম অবজ্ঞা করেই নিজের মতো পড়াশোনা করে জ্ঞানার্জন চালিয়ে যায় এবং যাচ্ছে। এদের লক্ষ্য কেবল পরীক্ষায় পাশ করে চাকরি পাওয়া নয়। এরা তো অবধারিত ভাবে চাকরি পাবেই এবং তার পরও জ্ঞানচর্চার ইতি টানতে এদের মন চায় না। “জানার কোনো শেষ নাই, জানার চেষ্টা বৃথা তাই”- এ কথা তাদের হাসির খোরাক যোগায়।
এইরকম যুক্তিনির্ভর মানসিকতা কিছু কিছু(সকল নয়) ছাত্রছাত্রীর মধ্যে পরিলক্ষিত হয় কারন শৈশব থেকেই তাদের বেড়ে ওঠার পরিবেশ সঠিক থাকে; সঠিক থাকে পারিবারিক ও সামাজিক শিক্ষা দানের মাধ্যমও। আর সেই কারনেই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার অপটুতার বিরুদ্ধে একরকম ব্যক্তিগত প্রতিবাদ জানিয়ে নিজের মতন করে পড়াশোনা করতে থাকে তারা। প্রকৃত শিক্ষা ও প্রকৃত জ্ঞান অর্জনে সক্ষম হয়।
তবে সমস্যাটা সেখানে নয়, যে সকল ছাত্রছাত্রীরা বর্তমান শিক্ষা-পরিকাঠামোর উপরেই নির্ভর করে রয়েছে তারা কি কেবল নোট পড়েই চাকরি পাবে? বেশতো, তাই ভালো। তাহলে পরিচালকবর্গের কাছে আনুরোধ জানাব যে এই নোট ভিত্তিক পড়াশোনার উপযোগীতা বিষয়ে আপনাদের মতামতটা একটু জনসামখ্যে প্রকাশ করুন…। এ বিষয়ে ছাত্রছাত্রীদের মতামত জানার চেষ্টা করুন…।
এটা তো একটা রক্ষণশীলতার নামান্তর, যা যেমন চলছে চলুক...! আসলে এইসব শিক্ষার ঠেকাদারদের সময় নেই নতুন এবং আরও উন্নত মানের কিছু উপায় উদ্ভাবন করার। বিশ্বের প্রথম সারির দেশ গুলোর শিক্ষাব্যবস্থা আর আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার তুলনা করলে দেখাযাবে যে আমরা কত পিছিয়ে! নানান কারনে ওইসব দেশ গুলোর সমকক্ষ না হতে পারলেও তাদের দেখে তো কিছুটা হলেও শেখা যায় এবং পরিবর্তন করা যায়...? আধুনিকতার নামে তো তাদের চাল-চলনের কিচ্ছুটি অনুকরণ করতে ছাড়ি না, তবে শিক্ষার ক্ষেত্রে সামান্য কিছু আনুসরণ করলে কি ক্ষতি?
এই ভাবে পরীক্ষার সময় নোট লেখার থেকে তো পাশে বই খুলে টোকা অনেক ভালো। কারন নোট মুখস্থ করে লেখা আর বই খুলে লেখা দুটোই তো অপরের লেখা কথা টুকেদেওয়ার নামান্তর মাত্র। এ ক্ষেত্রে স্টুডেন্টের হাতের লেখা সুন্দর করা ছাড়া আর স্বকীয় গুনের কিছুই থাকে না। কেউ নিজের যুক্তি তে লিখলেও মনেকরা হয় যে সেও নোট মুখস্থ করেই লিখেছে! এদিকে আবার প্রতিটা প্রশ্নপত্রের উপরে লেখা থাকে-“নিজের ভাষায় উত্তর দাও”। এটা একটা যেন চরম হাস্যকর ব্যাপার! এই ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থায় সারা বছর ছাত্রছাত্রীদের বিভিন্ন বিষয় পড়িয়ে শেষে গিয়ে পরীক্ষার সময় তাদের নিজস্ব মতামতেরই কোনো গুরুত্ব দেওয়া হয় না। যদি কোন ছাত্র বা ছাত্রী ‘নিজের ভাষায় উত্তর’ দিয়েও থাকে, পরীক্ষক তো আর সে সম্পর্কে নিশ্চিৎ হতে পারছেন না। সুতরাং তার ব্যক্তিগত দক্ষতার কোনো মূল্যই দেওয়া হচ্ছে না, অন্য নোট মুখস্তকরা স্টুডেন্টের মতো সেও গড়পড়তা একই নাম্বার পাচ্ছে।
এই ধরনের পরীক্ষণ পদ্ধতিতে এটা বোঝা সম্ভব নয় যে উত্তরটা স্টুডেন্টের নিজস্ব লেখা না নোট আওড়ে লেখা। এই ভাবে কি প্রকৃত যোগ্যতা বিচার করা সম্ভব? না প্রকৃত শিক্ষা প্রদান করা সম্ভব?
যে সকল ছাত্রছাত্রীরা এই গড্ডলিকাপ্রবাহে গা ভাসিয়ে বিনা সঙ্কোচে নোট মুখস্ত করে চলেছ এবং গড়পড়তা পরীক্ষায় সকলেই প্রায় একই নাম্বর পাচ্ছ, তাদের জিজ্ঞাসা করি তোমরা কি এতেই খুশি? তোমরা তো চার্লস ডারউইন এর “যোগ্যতমের উদবর্তন” মতবাদ কেও মিথ্যা প্রমানিত করলে দেখছি! কারন তোমাদের মধ্যে কে যোগ্য তা তো বোঝা মুশকিল!
এইবার জনতা-এক্সপ্রেস এর উদ্দেশে বলি যে আপনারা এই নোট পড়া বিদ্বান দের থেকে একটু সতর্ক থাকবেন। কারন এই ধরনের জীবদের পড়াশোনার মাধ্যমে কোনো আদর্শ গড়েওঠে না। এরা ছাত্র বয়সে খাতার নোটের জন্য দৌড়ায় আর প্রাপ্ত বয়সে দৌড়ায় টাকার নোটের জন্য।
তাই ছাত্রছাত্রীদের এহেন দৌড়ে নিযুক্ত না করে প্রকৃত পদ্ধতিতে শিক্ষা দান করাই স্বাস্থ্যকর হবে বলে আমার মনেহয়। যাতে তারা নোট পড়া বিদ্বান না হয়ে, ব্যক্তিগত মনীষাকে নতুন যুক্তির পথে উন্মুক্ত করতে পারে। যার জন্য প্রথম প্রয়োজন তাদের স্বাধীন ভাবে চিন্তা করতে দেওয়া, মাথায় নোটের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া নয়।
এই পৃথিবীতে রাজার সংখ্যা খুবই অল্প। কারন, রাজ শিক্ষায় শিক্ষিত ব্যক্তিও খুবই অল্প। সেই রাজ শিক্ষা পেলে তবেই “আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে”- গান টি গাইবার যোগ্য হতে পারব। সঠিক শিক্ষাই আমাদের পরিশ্রমের প্রকৃত উদ্দেশ্য সফল করবে; “মোদের রাজার সথে মিল” ঘটাবে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন