অশ্রুনদীর সুদূর পারে
‘অহম্ বহুষ্যামি’ বা ‘আমি বহু হব’ ঘোষণা করে ভগবান বহুধা হলেন। বহু রূপে মহাবিশ্বে ব্যাপ্ত হলেন। এক একটা রূপ পরস্পরের প্রতি আকর্ষণ অনুভব করতে থাকল পূর্বের একক অবস্থা স্মরণ করে। তারই নাম প্রেম। তার অনেক রূপ, বৈশিষ্ট্যের প্রকারান্তরে অনেক তার বৈচিত্র্য, অনেক তার নাম। ভাললাগা, প্রীতি, বাৎসল্য, দাম্পত্য-প্রেম, ঈশ্বরপ্রেম – নানাবিধ নাম তার। কিন্তু মিলনাকাঙ্খার ওপারে মিলন কোথায়? লীন হয়ে যাওয়ার সুখ কোথায়? একি মিলনাকাঙ্খার যন্ত্রণায় আত্মসুখ? তা না হলে ‘অহম্ বহুষ্যামি’ যে মিথ্যা হয়ে যায়! ভগবান কি কোনও এক সময়ে নেওয়া নিজের সিদ্ধান্তে নিজেকেই কষ্টের ফাঁদে ফেলেছেন? তিনি কি অনুতপ্ত? না কি রূপবৈচিত্র্যের আস্বাদনে, প্রেমবৈচিত্র্যের বিভিন্নতার উপলব্ধিতে আজও তিনি মুগ্ধ, বিস্মিত ও পুলকিত?
প্রেমী প্রেমাস্পদের প্রতি আকর্ষণের আহ্বানে পরস্পরের সান্নিধ্যে আসে। পরস্পরে লগ্ন হয়। মিলনের সুখানুভূতিতে ভেসে যায় দুটি সত্তা। কিন্তু এই মিলন কেমন মিলন? কতটুকু তার গভীরতা? কতক্ষণ তার স্থায়িত্ব? কী তার তাৎপর্য? ক্ষণিকের এই মিলন। শরীর দুটি তো একে অন্যের সঙ্গে সম্পূর্ণ লীন হতে পারে না! দুটি শরীর তো আবার পরস্পরের থেকে সরে যায়!‘দুঁহু কোড়ে দুঁহু কাঁদে বিচ্ছেদ ভাবিয়া’। মানসিক একইকরণ তো সম্ভব নয় তা যতই সমতা থাকুক না কেন, সম্পূর্ণ সমতা তো কখনোই লভ্য নয়। তাহলে অংশত শারীরিক মিলন ও হয়ত ক্ষণিকের মানসিক সহাবস্থান ও তার থেকে জাত সুখ - এতেই কি প্রেমের পরিণতি? মিলনান্তে প্রেম তো ক্ষয় হয় না! তা বাড়তেই থাকে। মিলনাকাঙ্খাও থেকে যায়। সেবার উপাচারে প্রেমের পূজা তো চলতেই থাকে। আবার, শারীরিক মিলনের ব্যাপার বাদ দিয়েও শুধু মানসিক সমতাজনিত নৈকট্য এবং একই সঙ্গে বেশ কিছু ক্ষেত্রে মানসিক ভিন্নতা- এই সমতার সঙ্গে বিষমতার বিচিত্র সহাবস্থানকে আস্বাদন করে যে সুখ ও আনন্দ অন্তর থেকে উৎসারিত হয়, তা পরস্পরকে যে দৃঢ় বাঁধনে বাঁধে, তারই নাম প্রেম। একই রকম ভাবে দুটি শরীরের মধ্যে যে সমতার মধ্যে বিষমতা এবং বিষমতার মধ্যে সমতার সৌন্দর্য উপস্থিত, তা-ই শারীরিক আকর্ষণের মূল। একই উৎসের জন্য আত্মিক সমতা যেমন বর্তমান, তেমনি আত্মিক বিভিন্নতাও রয়েছে। আর সেই একই সমতার মধ্যে বিষমতা এবং বিষমতার মধ্যে সমতার সত্য আত্মিক আকর্ষণেরও হেতু। সমতা ও বিষমতা - দুটি বিষয় আছে বলেই প্রেমও আছে। আর এই সমতা বিষমতার ধারণা বজায় রাখতে গেলে সম্পূর্ণ লীন হওয়া চলে না। অস্তিত্বের দ্বৈতভাব বজায় রাখতেই হয়। আর সেই কারণেই যাও বা মিলন ঘটে, তাও ঘটে অংশত এবং একই সঙ্গে তা ক্ষণস্থায়ী। সেই আংশিকতা ও ক্ষণস্থায়িত্বের জন্য মিলনাকাঙ্খা থাকে চিরজাগরুক। আর একই কারণে বিরহও চিরকালীন। বিরহের কষ্টবোধের কারণ প্রেম, যা প্রতি নিয়ত মিলনের জন্য আকর্ষণ করেই চলেছে, যে আকর্ষণের প্রভাবে কাছাকাছি যাওয়া যায়, অংশত মিলনের ক্ষণিক আনন্দ পাওয়া যায়, কিন্তু অস্তিত্ব বজায় রেখে সম্পূর্ণ লীন হওয়া যায় না। সেই ক্ষণিক মিলনান্তে পুনরায় বিচ্ছিন্ন হতেই হয়।
ঈশ্বর প্রেমেও একই কথা। অস্তিত্ব বজায় রেখে ঈশ্বরের সঙ্গে মিলিত হওয়া যায় না। লীন হতে হলে অনস্তিত্ব চলে আসে। মৃত্যু যদি ঈশ্বরের সঙ্গে মিলন ঘটায়ও, সেই মিলনও কি চিরকালীন? তা তো নয়! কারণ, ভাগবদ্গীতার শাশ্বত বাণী ‘জাতকস্যহি ধ্রুব মৃত্যু, জন্ম মৃতস্য চ’, কিম্বা আদি শঙ্করাচার্যের অমোঘ উক্তি ‘পুণরপি জীবনম্, পুণরপি মরণম্, পুণরপি মাতৃজঠরে শয়নম্’। জন্মমৃত্যুর চক্রের বাইরে যাওয়া তো লীন হওয়া। আর তা আনে চিরকালীন অনস্তিত্ব বা ঈশ্বরের সত্ত্বায় বিলীন হওয়া। তখন তো আর আলাদা করে ঈশ্বরের জন্য প্রেম থাকতে পারে না। তাই প্রেমাস্পদের জন্য প্রেমের উপস্থিতির প্রথম শর্তই হল দুটি পৃথক অস্তিত্ব। আর সেই পৃথগতার কারণে বিরহ অবশ্যম্ভাবী। সুতরাং প্রেম এবং বিরহ একে অন্যের সঙ্গে অঙ্গাগীভাবে জড়িত। প্রেম থাকলে বিরহ থাকবেই। বিরহ থাকলে প্রেম থাকবেই। প্রেম না থাকলে বিরহ নেই; বিরহ না থাকলে প্রেম নেই। বিরহেই প্রেমের প্রকাশ। আকাশ আর পৃথিবীর মধ্যে প্রেম থাকলেও তাদের মধ্যেকার দুস্তর দূরত্ব রয়েই যায়। বিরহতপ্ত পৃথিবী হাহাকার তুলে জল বাস্প করে মেঘের বারতা পাঠায়। আকাশের যন্ত্রণা বৃষ্টি হয়ে কান্নায় পৃথিবীকে সিক্ত করে, স্নিগ্ধ করে। আর পরস্পরের দিকে চিরকাল ধরে চেয়ে রয়।
বিরহের তীব্র বেদনা আর একই সঙ্গে মিলন-সম্ভাবনার সুখ এই যুগল অনুভূতির অনির্বচনীয় স্বাদ আর সেই সঙ্গে আংশিক ক্ষণিক মিলনের তাৎক্ষণিক আনন্দ এই সবকিছুই সম্মিলিতভাবে প্রেমের অনাবিল মাধুর্য নিয়ে আসে। মিলনাকাঙ্খা, মিলনের সম্ভাবনার সুখ, সেই সময়ে মিলিত হতে না পারার কষ্ট, মিলনের জন্য নিজের প্রচেষ্টা বা প্রেমাস্পদের প্রচেষ্টার সাফল্যকামনা এই সব কিছু নিয়েই বিরহ। মিলন তো একে আংশিক, তায় ক্ষণস্থায়ী ‘রাধার কী হইল অন্তরে ব্যথা’, কিম্বা ‘কেমনে পাইব সই তারে ... পাসরিতে করি মনে, পাসরা না যায় গো,/ কি করিব কি হবে উপায়?’ বিরহেই প্রেমের পরিস্ফুটন ঘটে ‘কান্ত পাহুন কাম দারুণ ...‘আজু রজনী হাম ভাগে পোহায়নু/ পেখনু পিয়া মুখ চন্দা’ এবং ‘দুঁহু কোড়ে দুঁহু কাঁদে বিচ্ছেদ ভাবিয়া’। প্রেমের সমৃদ্ধি হয় বিরহ ও ক্ষণস্থায়ী আংশিক মিলনে ‘হাসিতে হাসিতে, পিরীতি করিয়া,/ কাঁদিতে জনম গেল’। প্রেমের পরিণতিও বিরহে। প্রেমের পথ তাই মূলত বিরহব্যথিত। এই শুদ্ধ ব্যথায় স্নানের সুখ প্রেম ছাড়া আর কোথায় লাভ করা যায়? এই সুখ জগৎসৃষ্টির মূল কথা, সংসার স্থাপন প্রতিপালনেরও মূল সুর। নব নব রূপে নব নব রূপের সাথে নব নব আস্বাদের বিরহব্যথার সুখ তাই সেই তিনি আস্বাদন করে চলেছেন যুগে যুগান্তরে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন